মোটেলের সামনের গেট দিয়েই বেরোল বার্নার। গোপনীয়তার ধার ধারছে না। তারমানে সে কল্পনাই করেনি ওর ওপর কেউ নজর রাখছে। সোজা এগোল ডকের দিকে।
নারকেল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওর পিছু নিল রবিন ও মুসা।
ডকে নোঙর করে রাখা ‘শার্ক’ নামের একটা মাছধরা জাহাজে গিয়ে উঠল
ডকে স্তূপ করে রাখা কতগুলো কাঁকড়া-ধরা ফাঁদের আড়ালে আত্মগোপন করে জাহাজটার ওপর নজর রাখতে লাগল দুজনে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও বোটের ভিতর থেকে কাউকে বেরোতে না দেখে ফিসফিস করে মুসা বলল, ‘ওই জাহাজে উঠব কী করছে ওরা দেখব।’
‘পাগল হয়ে গেলে নাকি!’ বলল রবিন। ‘পুলিশকে খবর দিলেই তো হয়।’
‘পুলিশকে খবর দেয়ার মত প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। অত সময়ও নেই। ডাকাতগুলো কী করে দেখতে হলে এটাই সুযোগ।’
কাঁকড়া-ধরা ফাঁদের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল দুজনে। কয়েকটা মাছধরা জাহাজ, সেইলবোট আর ইয়টের সামনে দিয়ে চলে এল শার্ক জাহাজটার কাছে।
রবিনকে মাথা নিচু করে রাখতে বলল মুসা। জাহাজ থেকে আসা আলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলল। পা টিপে টিপে তক্তার সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে এল দুজনে। পা রাখল ডেকে।
মুসার ভারে মড়মড় করে উঠল তক্তা। বরফের মত জমে গেল ও।
কেউ বেরোল না কেবিন থেকে। রবিনকে নিয়ে আবার এগোল মুসা। ডেকে উঠে নিচুস্বরে বলল, ‘এখানেই থাকো।’
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে প্রধান কেবিনটার কাছে চলে এল ও। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করল একটা জানালার কাছে। সাবধানে উঁকি দিল ভিতরে।
বদ্ধ কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে গুজ বার্নারকে দেখতে পেল। ফক্স ডেনভারের সঙ্গে কথা বলছে। দুজনেরই চোখেমুখে রাগ। কোনও একটা ব্যাপারে যেন একমত হতে পারছে না।
কথা বোঝা যাচ্ছে না। ভালমত শোনা দরকার। গলা লম্বা করে দিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা। কেবিনের পিছনের দরজাটা চোখে পড়ল। খোলা।
কেবিনের পাশ ঘুরে দরজাটার কাছে চলে এল ও।
‘সময় থাকতে কেটে পড়া দরকার,’ বার্নারের কথা কানে এল মুসার। ‘ওই ছেলেগুলো আমাকে সন্দেহ করে ফেলেছে। পিছে লেগেছে। ঝড়টা আঘাত হানার আগেই গেইটর সোয়াম্প থেকে মোহরগুলো তুলে নিতে না পারলে আর কখনও পারব না।’
‘তোমার অসাবধানতার কারণেই আজ এতসব সমস্যা,’ ডেনভারের উত্তপ্ত কণ্ঠ শোনা গেল। ‘বস্তাটা রাখলে এয়ারবোটের একেবারে গলুইয়ের কাছে, ওরকম জায়গায় কেউ রাখে? ওখানে না রাখলে পানিতেও পড়ত না, এত ঝামেলাও পোহাতে হতো না আমাদের।’
‘আমাকে বকে কী হবে? ব্যাংকের ভল্টের তালা খুলতে নিয়ে গিয়েছিলে, খুলে দিয়েছি। আমি যেটা পারি না সেই দায়িত্ব আমার ওপর চাপালে কেন?’
হঠাৎ খড়খড় করে উঠল শর্টওয়েভ রেডিওর স্পিকার। ভারি একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘গেইটর বলছি শার্ককে। হারানো মালগুলো খুঁজে পেয়েছি আমি। তিরিশ মিনিটের মধ্যে জাহাজে পৌছাচ্ছি।’
রাগ চলে গেল ডেনভার আর বার্নারের চেহারা থেকে। হাসি ফুটল। রেডিওর হ্যান্ড রিসিভার তুলে নিল ডেনভার। ‘একটা কাজের কাজই করেছ, গেইটর। শত্রুক্যাম্পের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছ? ওভার।
‘বিচ্ছিন্ন করেছি। একটা দারুণ চমকও রেখে এসেছি বিচ্ছুগুলোর জন্যে।’
সাঙ্কেতিক বাক্য ব্যবহার করছে ওরা। রেডিওর কণ্ঠটা মুসার পরিচিত। মরিস মরিসন। বুঝতে পারল, ওর সাঙ্কেতিক নাম গেইটর। হারানো মাল বলে নিশ্চয় সোনার মোহরগুলোকেই বুঝিয়েছে। কিন্তু ‘শত্রুক্যাম্পের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন’ আর ‘দারুণ চমক’ বলে কী বোঝাতে চেয়েছে?
‘ভাল, গেইটরটেইল, ডেনভার বলল। ‘ফ্লোরিডা বে’র নি জায়গায় দেখা হবে। ওভার অ্যান্ড আউট।’
রিসিভার নামিয়ে রাখল ডেনভার। সাদা রঙের একটা হ্যাট তুলে মাথায় দিল। কমলা-কালো পালক লাগানো। কেবিনের দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চট করে সরে গেল রবিন। জাহাজের সামনের দিকে ছুটল। গ্যাঙপ্ল্যাঙ্ক বেয়ে আর নামার সময় নেই। নামতে গেলেই ডেনভারের চোখে পড়ে যাবে।
বুনো হাঁসের পরিচিত ডাক কানে এল।
ঝটকা দিয়ে ডানে মাথা ঘোরাতেই চোখে পড়ল মুসাকে। কার্গো হ্যাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পাগলের মত হাত নেড়ে হ্যাচ দেখিয়ে নীচে নেমে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে।
তাড়াতাড়ি হ্যাচের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঢাকনাটা তুলল। রবিনকে নিয়ে নীচে নেমে এল। জাহাজের স্টোরেজ এরিয়া অর্থাৎ মাল রাখার জায়গা এটা। কিন্তু ‘মাল’-এর নমুনা দেখে হাঁ হয়ে গেল দুজনেই।
হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে জাহাজের খোলে ফেলে রাখা হয়েছে ডেপুটি ক্যানার আর কিটি ওয়াটারম্যানকে।
গোঁ-গোঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন ডেপুটি। হাত তুলে ওপর দিক দেখিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করল মুসা।
ওপরে জাহাজের ডেকে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা সরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল মুসা ও রবিন। তারপর ক্যানার ও কিটির বাঁধন খুলতে শুরু করল।
মুখ থেকে কাপড় খুলতেই ডেপুটি বললেন, ‘বাঁচালে!’
‘এখানে এলেন কী করে?’ ডেপুটির পায়ের বাঁধন খুলছে রবিন।
‘ডকমাস্টারকে জরুরি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম,’ ডেপুটি জানালেন। ‘ডাকাতির রাতে বন্দরে যত জাহাজ ছিল সব স্থানীয়। আমি জানতে এসেছিলাম, এগুলোর মধ্যে কোনওটা ঝড়ের সময় জেটি থেকে সরেছিল কিনা।’
‘শার্ক,’ রবিন বলল।