বোটের দড়ি খুলে দিলেন ওয়াটারম্যান।
‘রবিন, হাত সরাও!’ চেঁচিয়ে বলল মুসা। ‘শিকারির ছাউনিতে কীভাবে যেতে হবে, বুঝে নিয়েছ?’
ওয়াটারম্যানের এঁকে দেয়া নকশাটা দেখাল রবিন। ইঙ্গিতে বোঝাল কোনদিকে যেতে হবে।
পূর্ব দিকে রওনা হলো মুসা।
ঘন হয়ে জন্মানো উঁচু ঘাস আর জলজ উদ্ভিদের মধ্যে পথ করে মাত্র কয়েক ইঞ্চি পানির ওপর দিয়েও যেভাবে ছুটে চলে এয়ারবোট, দেখে বিস্মিত হতে হয়।
জায়গামত পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল রবিন, ‘পরের ওই বাঁকটা পেরোলেই দেখা যাবে।’
সত্যিই দেখা গেল। দূর থেকেই কাঠের তৈরি ছাউনিটা চোখে পড়ল ওদের। টিনের চালায় মরচে পড়া। ডেবে গেছে। জানালার পর্দাগুলো ছেঁড়া। পরিত্যক্ত, বোঝাই যায়।
‘লম্বা ঘাসের মধ্যে বোট লুকিয়ে বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে পারি আমরা,’ মুসা বলল। তাহলে কারও চোখে পড়ব না।’
‘ঠিক বলেছো,’ রবিনও একমত।
ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল মুসা। একটা ম্যানগ্রোভ গাছের সঙ্গে বোটের দড়ি বাঁধল। নেমে পড়ল মাটিতে। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলল দুজনে। মাটি এখানে মোটামুটি শক্ত। পা ডাবছে না তেমন।
কিছুদূর গিয়ে হাত তুলে মুসাকে থামতে ইশারা করল রবিন। দুটো গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এখন ছাউনিটা। নীরব। নির্জন। কিটি বা অন্য কোন মানুষের ছায়াও চোখে পড়ছে না।
‘তুমি এখানে থাকো,’ রবিন বলল। ‘কেউ এলে সঙ্কেত দিয়ে আমাকে জানাবে।’
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ছাউনির পিছনে একটা জানালার কাছে চলে এল ও। সাবধানে মাথা তুলে জানালা দিয়ে উঁকি দিল। ভিতরে অন্ধকার। কেউ নেই। জানালা টপকে ভিতরে ঢুকল ও।
বাতাস ভেজা। ফাঙ্গাসের ভাপসা গন্ধ। মাছি ভনভন করছে। খোলা জানালাটা দিয়ে ক্রমাগত ঢুকছে-বেরোচ্ছে মাছিগুলো। মেঝেতে খড়ের একটা গদি পাতা। পাশে এক জগ পানি। চোখে আলো সয়ে এলে ঘরের কোণে একটা প্লাস্টিকের বস্তা চোখে পড়ল ওর।
বস্তার ভিতর রয়েছে একটা স্নরকেল, একটা সুইম মাস্ক, আর একটা ছোট যন্ত্র। একটা হাতল আর একটা ডায়াল লাগানো রয়েছে যন্ত্রটায়। ডায়াল ঘোরাতেই গুঞ্জন করে উঠল। সুইম মাস্কের ধাতব ধারগুলোর কাছে যন্ত্রটা আনতেই গুঞ্জনটা অনেক বেড়ে গেল।
‘মেটাল ডিটেক্টর!’ বিড়বিড় করল রবিন। মনে পড়ল, আগের রাতে প্যাডল বোটে বসে জলাভূমিতে অনেকটা এ রকম গুঞ্জন কানে এসেছিল। আরও একটা শব্দের কথা মনে পড়ল। ঘড়ঘড়ে শ্বাস টানার শব্দ।
কলটার ওপর হাত রেখে আপনমনেই হাসল রবিন। অদ্ভুত ওই শ্বাস টানার শব্দ কীসের ছিল, বুঝতে পারছে। মুখে সুরকেল লাগিয়ে পানিতে ডুব দিয়েছিল কেউ। টর্চের আলোয় মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে পানির নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল লোকটা।
হঠাৎ ডেকে উঠল একটা বুনো হাঁস। কান খাড়া করল রবিন।
মুসার সঙ্কেত। কাউকে আসতে দেখেছে ও।
সামনের একটা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল একটা ক্যানু এসে তীরে ভিড়েছে। ভোজালীর মত মস্ত একটা ছুরি হাতে ছাউনির দিকে এগিয়ে আসছে কিটি।
তিন লাফে পিছনের খোলা জানালাটার কাছে চলে এল রবিন। নিঃশব্দে জানালা ডিঙিয়ে বেরিয়েই শুয়ে পড়ল মাটিতে। গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল মাটির একটা ডিবির কাছে। ঢিবিটার গোড়ায় পানি জমে আছে। ভিজে গেল কাপড়। কাদায় মাখামাখি শরীর। তবে কিটির অলক্ষে পালিয়ে আসতে পেরেছে এটাই স্বস্তি।
কেবিনের বেশ কিছুটা দূর দিয়ে ঘুরে মুসার কাছে চলে এল ও।
‘ভিতরে ঢুকেছে কিটি, ফিসফিস করে মুসা বলল। ‘কী দেখলে?’
‘একটা স্নরকেল, একটা সুইম মাস্ক আর একটা মেটাল ডিটেক্টর। কাল রাতে অ্যালিগেইটর গুঁতো মেরে আমাদের বোট ডোবায়নি। মানুষই ডুবিয়েছে। কিটিও হতে পারে। ওসব যন্ত্রপাতি দিয়ে পানির নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল ও।’
‘কী খুঁজছিল?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল রবিন। ‘জানি না।’
মরচে পড়া কব্জার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে খুলে গেল ছাউনির দরজা। বেরিয়ে এল কিটি। হাতে স্নরকেল, মাস্ক আর মেটাল ডিটেক্টর।
ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল মুসা ও রবিন। আড়াল থেকে দেখতে লাগল।
ক্যানুটার কাছে হেঁটে গেল কিটি। দুজনকে অবাক করে দিয়ে মেটাল ডিটেক্টরটা আছড়ে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলল খাঁড়ির মাঝখানে পানিতে। ভোজালী দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটল স্নরকেল আর মাস্কটা। তারপর ক্যানুতে চেপে চলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুজনে। অবশেষে কথা বলল মুসা, ‘জিনিসগুলো ওরকম করে ভাঙল কেন? প্রমাণ নষ্ট করল?’
‘না। প্রমাণ নষ্ট করতে চাইলে ওগুলো কেটেকুটে ছাউনির কাছে ফেলে যেত না। কিশোর থাকলে এখন ভাল হতো। ও হয়তো বুঝতে পারত।’
‘এতক্ষণে নিশ্চয় ফিরে এসেছে। চলো, যাই।’
ফিশিং ক্যাম্পে ফিরতেই ছুটে এল উত্তেজিত হ্যারিস। ‘এইমাত্র রেডিওর স্থানীয় সংবাদে খবর শুনলাম বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্পে একটা হাইড্রোপ্লেন ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছে।’
চমকে গেল রবিন। ‘রাস্টি!’
‘কী হয়েছিল?’ ডকে এসে হাজির হয়েছেন গুজ বার্নার।
‘বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্পে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং, হ্যারিস জানাল। ‘আমার মনে হয় রাস্টির প্লেনটাই।’
‘তাই নাকি!’ চোখ বড় বড় হয়ে গেছে বার্নারের।
‘থাক, আর ভাল সাজার দরকার নেই!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘কিছুক্ষণ আগে আপনিই ওদের যাওয়ার খবরটা রেডিওতে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি বলেননি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে যাবে ওরা? বেশ, কী করা যায় দেখছি।’