‘হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তি। আবার এমনও হতে পারে, বিল আর মরিস দুজনেই মিথ্যুক। আমাদের সামনে অভিনয় করেছে।’
‘তাহলে বলতে হয় মস্ত অভিনেতা ওরা।’
সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে পৌঁছে দেখা গেল বোট আছে, কিন্তু সবগুলোকেই শিকল দিয়ে বেঁধে তালা লাগিয়ে রেখে চলে গেছেন ডিন ওয়াটারম্যান। তালা খোলা সম্ভব না।
কী করবে চিন্তা করতে লাগল ওরা। হঠাৎ তুড়ি বাজিয়ে মুসা বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’
জেনালের স্টোরের পিছন দিয়ে ঘুরে ডিনের স্যালভিজ ইয়ার্ডে কিশোর ও রবিনকে নিয়ে এল ও। বিচিত্র চেহারার একটা জলযান দেখিয়ে হেসে বলল, ‘ওই যে আমাদের বাড়ি ফেরার বাহন।’
ভ্রূকুটি করল রবিন। ‘কী ওটা?’
‘প্যাডল বোট। সকাল বেলা ল্যাসো প্র্যাকটিস করার সময় দেখেছি।’
‘ইঞ্জিন কই?’
‘ইঞ্জিন নেই। সাইকেলের মত প্যাডল ঘুরিয়ে চালাতে হয়।’
‘কিন্তু এটাতে করে ফিশিং ক্যাম্পে পৌছতে তো অনন্তকাল লেগে যাবে।
‘উপায় কী? অনন্তকাল লাগলেও একটা সময় তো পৌঁছব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো যাওয়াই হবে না।’
টেনে-হিঁচড়ে বোটটাকে ডকে নিয়ে এল ওরা। পানিতে নামিয়ে চড়ে বসল। একমাত্র সিটটায় বসল মুসা, যেটাতে বসে প্যাডল খোরাতে হয়। দুই পাশে হাঁটু মুড়ে বসল কিশোর ও রবিন, এমনভাবে যাতে বোটের ভারসাম্য বজায় থাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার ভয় আছে।
ধীরে ধীরে প্যাডল ঘোরাতে লাগল মুসা। ঘণ্টায় এক মাইল গতিতে চলতে থাকল বোট।
’এই গামলায় করে মাঝরাতের আগে কোনমতেই ক্যাম্পে পৌঁছতে পারব না,’ রবিন বলল। ‘মরিস তো ওদিকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, মাঝরাতের পর আর পানিতে থাকা যাবে না।
‘যাদের দিয়েছে দিয়েছে, আমাদের তো আর দেয়নি,’ হেসে বলল কিশোর। ‘ভাল বোট না পাওয়াতে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। ওর সামনে পড়ে গেলে এত রাতে জলাভূমিতে থাকার একটা ছুতো দেখাতে পারব। বোট জোরে না চললে আমরা কী করব?’
প্যাডল ঘুরিয়ে বোটটা চালানো খুব পরিশ্রমের ব্যাপার। একা একটানা বেশিক্ষণ পারল না মুসা। পালা করে ঘোরাতে লাগল তিনজনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সবাই।
‘রবিন, চালানো বন্ধ করলে কেন?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘পায়ের পেশিতে খিঁচ ধরে গেছে।’
‘তা বললে তো হবে না। ক্যাম্পে পৌঁছতে হলে চালাতেই হবে।’
‘আমার মনে হয় কাছাকাছি চলে এসেছি,’ কিশোর বলল।
ভারি দম নিল রবিন। আবার প্যাডল ঘোরানো শুরু করল।
‘এই, একটু থামো তো!’ আচমকা বলে উঠল মুসা। ‘ওই দেখো!’
বোটের একপাশে কালো আবছামত একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, কালো আকাশের পটভূমিতে একজোড়া সাইপ্রেস গাছও চোখে পড়ছে। ওগুলোর সামনে একটা ভুতুড়ে আলো আগেপিছে নড়ে বেড়াচ্ছে, যেন কোন দানবের চোখ।
‘মরিস নিশ্চয় অ্যালিগেইটর ধরতে বেরিয়েছে,’ রবিন বলল। ‘তার বোটের আলো।’
‘আশ্চর্য!’ তাকিয়ে আছে মুসা। ‘আলোটা পানির নীচে!’
‘শব্দ শুনছো!’ ফিসফিস করল রবিন। ‘মানুষ ওরকম শব্দ করে না!’
অদ্ভুত এক ধরনের ঘড়ঘড়ে শব্দ, যেন পানিতে ডুবে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে কেউ, নিতে কষ্ট হচ্ছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছে গুঞ্জনের মত শব্দ।
আলো আর এই শব্দ কীসের না দেখে যাবে না কিশোর। রবিনকে সেদিকে যেতে বলল।
প্যাডল ঘুরিয়ে আলোর দিকে এগোতে শুরু করল রবিন। ওরা চল্লিশ গজ দূরে থাকতে নিভে গেল আলোটা। কেবল আধখানা চাঁদের আলো পানির ওপর আভা সৃষ্টি করে রেখেছে।
‘খাইছে! বুদবুদ!’ আমচকা বলে উঠল মুসা। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারল না।
কিশোর আর রবিনও দেখল পানির নীচ থেকে ওঠা বুদবুদের একটা লম্বা সারি এগিয়ে আসছে বোটের দিকে।
‘কী ওটা?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘যা-ই হোক,’ জবাব দিল কিশোর, ‘আমাদের বোটের নীচ দিয়ে যেতে চায়!’
‘অ্যালিগেইটর!’ গলা কাঁপছে মুসার। ‘আজ আর বাঁচব না! মরব সবাই! কোন্ কুক্ষণে যে এই প্যাডল বোটের কথা মাথায় এসেছিল…’ কথা শেষ হলো না ওর। বোটের তলায় প্রচণ্ড আঘাত হানল কীসে যেন। কাত হয়ে যাচ্ছে বোট।
ছয়
‘ঝাঁপ দাও, জলদি!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
পুরো কাত হয়ে গেল বোট। একটা পাশ ডুবে গেল। জলাভূমির পানিতে ছিটকে পড়ল তিনজনে।
সঙ্গীদের সাঁতার কাটতে বলে যত দ্রুত সম্ভব দ্বীপের দিকে সাঁতরে চলল কিশোর।
সাঁতার কাটার সময় জোরে জোরে পানিতে লাথি মারছে মুসা। আশা, এতে যদি ঘাবড়ে গিয়ে কামড়ে ধরা থেকে বিরত থাকে অ্যালিগেইটরটা।
হঠাৎ ওর পায়ে কাদা ঠেকল। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়। পানি মাত্র কয়েক ফুট গভীর ওখানে। পা টেনে টেনে হেঁটে এগোল দ্বীপের দিকে। তীরে উঠে দুটো গাছের একটাতে উঠে পড়ল ও। প্রায় টেনে- হিঁচড়ে কিশোর আর রবিনকে তুলে নিল গাছের ডালে। পরিশ্রমে কাহিল হয়ে গেছে।
অ্যালিগেইটরটা কী করছে এতক্ষণে দেখার সুযোগ পেল ওরা। কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না ওটাকে। রহস্যময় সেই আলোও অদৃশ্য।
‘কী করব এখন?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘আপাতত একটা আশ্রয় তো পেলাম,’ কিশোর বলল। ‘রাতটা গাছে বসেই কাটাতে হবে। সকাল না হলে আর কিছুই করার নেই।’
কাণ্ডে হেলান দিয়ে গাছের ডালে যতটা সম্ভব আরামে বসার চেষ্টা করল ওরা। সীমাহীন ক্লান্তি। মশার কামড় আর নিশাচর ইগ্রেটের ডাককে উপেক্ষা করে বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল।
সকাল বেলা পাঁজরে খোঁচা খেয়ে ঘুম ভাঙল রবিনের। চোখ মেলে দেখে তীর ঘেঁষে ভেসে রয়েছে পন্টুন বোটটা। একটা মাছধরার ছিপ দিয়ে ওকে খোঁচা দিচ্ছে হ্যারিস স্মিথ।