ধুর, এসো তো, বলল রবিন। আমাদের এমনকী মইও লাগবে না। স্রেফ জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই হবে।
পকেটে জেরিকে ঢুকিয়ে রাখল রবিন। জানালা দিয়ে বের করে দিল এক পা।
দাঁড়াও! কিশোর রবিনের আরেক পা চেপে ধরল। ও পড়ল:
রেইন ফরেস্টের তিনটি স্তর। ঘন বৃক্ষশীর্ষ
সবচেয়ে উপরের স্তর তৈরি করে। প্রায়ই এর
উচ্চতা হয় ১৫০ ফীট। একে বলে অরণ্যের
শামিয়ানা। তারপর দ্বিতীয় স্তর,
এবং তারপর বনতল।
ফিরে এসো! চেঁচাল কিশোর। আমরা সম্ভবত মাটি থেকে দেড়শো ফীট ওপরে! এটা বনের শামিয়ানা!
বলো কী! বলল রবিন। সাত করে ঢুকে পড়ল ট্রী হাউসের ভিতরে।
আমাদেরকে মই ব্যবহার করতে হবে, বলল কিশোর। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বসল। মেঝের গর্ত থেকে পাতা সরাল। নীচের দিকে চাইল।
মইটা বিশাল এক গাছের ডাল-পালা ভেদ করে নেমে গেছে। কিন্তু অতদূর কিশোরের দৃষ্টি গেল না।
নীচে কী আছে কে জানে, বলল। সাবধান!
ব্যাকপ্যাকে রেইন ফরেস্টের বইটা ঢুকিয়ে রাখল ও। এবার পা রাখল দড়ির মইতে।
নামতে শুরু করল। রবিন আর মুসা অনুসরণ করল।
পাতা ভেদ করে নামতে হচ্ছে।
শামিয়ানার নীচের স্তরে চলে এল ও।
বনতলের দিকে চাইল। অনেক দূরে।
বাব্বা, ফিসফিস করে বলল।
বৃক্ষ শীর্ষের পৃথিবীর সঙ্গে এই পৃথিবীর বিস্তর ফারাক।
সূর্য আড়ালে, তাই এখানে বেশ ঠাণ্ডা। স্যাঁতসেঁতে আর নিস্তব্ধ পরিবেশ।
শিউরে উঠল কিশোর।
০৪.
নড়ল না ও। বনতলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
কী হলো? উপর থেকে প্রশ্ন করল মুসা।
জবাব দিল না কিশোর।
বিরাট বড় কোন মাকড়সা দেখনি তো? রবিনের জিজ্ঞাসা।
না…তা না। কিশোর গভীর শ্বাস টানল।
আমাদেরকে নামতে হবে, ভাবল ও। মরগ্যানের জন্য বিশেষ জিনিসটা খুঁজে বের করতে হবে।
মাকড়সা নেই। ভয় পেয়ো না, গলা চড়িয়ে বলল কিশোর। মই বেয়ে আবারও নামতে শুরু করল।
দ্বিতীয় স্তর ভেদ করে নেমে চলল তিন বন্ধু। শেষমেশ মাটিতে পা রাখল।
জঙ্গলের ভিতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ।
গাছগুলো যেমন উঁচু তেমনি মোটা। চারদিকে লতা আর শ্যাওলা ঝুলে রয়েছে। মাটি মরা পাতায় ছাওয়া।
কিছু করার আগে বইটা খুলে দেখি, বলল কিশোর।
রেইন ফরেস্টের বইটা বের করল ও। বৃক্ষশীর্ষের নীচে আঁধার দুনিয়ার এক ছবি খুঁজে নিল। পড়ল ও।
রেইন ফরেস্টে অনেক প্রাণী পরিপার্শ্বের
সঙ্গে মিশে থাকে। একে বলে ক্যামোফ্লেজ।
বাপ রে, বলল কিশোর। বইটা বন্ধ করে চারধারে নজর বুলাল। এখানে অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। আমরা যদিও দেখতে পাচ্ছি না।
খাইছে, তাই? ফিসফিস করে বলল মুসা।
নিঃশব্দ বনভূমির চারদিকে চাইল ওরা। কিশোর অনুভব করল অসংখ্য অদৃশ্য চোখ লক্ষ করছে ওদেরকে।
মরগ্যানের জিনিসটা ঝটপট খুঁজে বের করি এসো, ফিসফিস করে বলল রবিন।
পেলেও কি বুঝতে পারব যা খুঁজছি পেয়েছি? কিশোর বলল।
মনে হয় পারব, বলল রবিন। আঁধার ভেদ করে পা বাড়াল।
ওকে অনুগমন করল কিশোর আর মুসা। বিশাল সব গাছ আর ঝুলন্ত লতার মাঝখান দিয়ে সন্তর্পণে এগোচ্ছে ওরা।
হঠাৎই থমকে দাঁড়াল রবিন। দাঁড়াও-কী ওটা?
কীসের কথা বলছ? মুসা বলল।
শোনো-অদ্ভুত একটা শব্দ।
কান পাতল ওরা। শুকনো পাতা ভাঙার খড়-মড় শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ পাতার উপর দিয়ে হাঁটছে।
কিশোর চারধারে চোখ বুলাল। কাউকে দেখতে পেল না।
কিন্তু শব্দটা ক্রমেই জোরাল হচ্ছে।
কোন জানোয়ার? বিশাল কোন পোকা?
ঠিক এসময় নীরব অরণ্য জীবন্ত হয়ে উঠল।
পাখিরা বাতাসে ডানা মেলল। পাতার উপর দিয়ে লাফ দিল ব্যাঙেরা। গাছের গুঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল গিরগিটির দল।
অদ্ভুত শব্দটা ইতোমধ্যে আরও জোরদার হয়েছে।
বইতে হয়তো জানা যাবে, বলল কিশোর। বইটা খুলল ও। বিভিন্ন জাননায়ারের ছুটে পালানোর এক ছবি খুঁজে পেল। পড়ল ও :
জানোয়ারেরা খড়মড় শব্দ
শুনলেই ভয়ের চোটে পালায়।
শব্দটার অর্থ তিন কোটি
মাংসাশী ফৌজী পিঁপড়ে মরা
পাতা ভেদ করে এগিয়ে আসছে।
ফৌজী পিঁপড়ে! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। তিন কোটি!
খাইছে, কোথায়? চিৎকার ছাড়ল মুসা।
বুনো দৃষ্টিতে চারপাশে চাইল তিন বন্ধু।
ওই যে! আঙুল নির্দেশ করল রবিন।
ফৌজী পিঁপড়ে–কয়েক কোটি–পাতার উপর দিয়ে পিলপিল করে আসছে।
ট্রী হাউসের দিকে দৌড় দাও! চেঁচাল রবিন।
কোথায় ওটা? বলে চরকির মতন ঘুরল কিশোর। সব কটা গাছ দেখতে একইরকম। দড়ির মইটা কোথায়?
দৌড়াও! চেচাল রবিন।
তিন বন্ধু কালবিলম্ব না করে ঝেড়ে দৌড় দিল।
মরা পাতার উপর দিয়ে ছুটছে ওরা।
চওড়া গাছের গুঁড়ির মাঝখান দিয়ে দৌড়চ্ছে।
দৌড়চ্ছে ঝুলন্ত লতা আর শ্যাওলার পাশ দিয়ে।
মোটা মোটা শিকড় টপকাল ওরা।
কিশোর সামনে একটা ফাঁকা জমি দেখতে পেল। সূর্যের আলোয় আলোকিত।
ওদিকে! চেঁচিয়ে বলল ও।
আলো লক্ষ্য করে দৌড়ল তিন গোয়েন্দা। পথ করে নিল ঝোপঝাড় মাড়িয়ে।
এক নদীর তীরে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল ওরা।
ধীর গতির বাদামি পানির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তিনজন।
তোমার কি মনে হয় পিঁপড়েবাহিনী এদিকে আসবে? হাঁফাতে হাঁফাতে বলল রবিন।
জানি না, বলল কিশোর। কিন্তু আমরা যদি নদীর পানিতে গিয়ে দাঁড়াই, তা হলে সেফ। পিঁপড়েরা পানিতে নামবে না। এসো।
দেখো! হঠাই বলে উঠল মুসা।
নদীর কিনারে একটা ক্যানু দোল খাচ্ছে।
দূরে খড়-মড় শব্দ।
উঠে পড়ো। জলদি! বলল কিশোর।