ঢিবির দিকে উড়ে চলেছি যেন আমরা। রেসের জয়-পরাজয় এখুনি নির্ধারিত হয়ে যাবে। যথাসময়ে ব্রেক করে, ঘুরে যে ফিনিশ লাইনে আগে ফিরে আসতে পারবে তারই জিত হবে।
প্রতিযোগিতা নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলাম, অন্য কিছুই মাথাতে ঠাই পায়নি। একটু পরেই অনুভব করলাম সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে। বাইকটা মসৃণ গতিতে চলেছে, উল্টোপাল্টা কোন ব্যাপার নেই।
ঢিবিটা আর মাত্র পনেরো গজ দূরে। মার্ক ঠিক আমার পাশে টার্নিং পয়েন্টে। একসঙ্গে পৌঁছলাম আমরা, মার্ক ঘুরে চাইল আমার দিকে, দীপ্তি ছড়াল ওর চোখজোড়া।
চোখ সরিয়ে নিলাম আমি, ঘোরার জন্য ব্রেক চাপলাম। কিন্তু যতবারই ব্রেক চাপছি, বাইক ততই আরও জোরে ছুটছে! ঢিবিটা ঠিক আমার সামনে। থামতে পারছি না আমি। প্রচণ্ড গতিতে খাড়া ঢিবি থেকে তালগোল পাকিয়ে পড়ে যেতে চলেছি আমি!
১১
আগে কখনও এই ঢিবির ঢাল বেয়ে নামিনি। কেউ নামেনি। কাজটা অবৈধ, যেহেতু বিপজ্জনক। ঢিবির চূড়া থেকে যখন উড়ে গেল বাইকটা, আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। ঘাবড়ালে চলবে না।
ব্রেক আর কষলাম না। বাইকটা ঊর্ধ্ব গতিতে ছুটে চলেছে এখনও। আর ধরে থাকতে পারছি না। মনটাও বাইকের গতিতে রেস দিচ্ছে। তলপেট ফাঁকা। বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগছে মুখে। ঢিবির পাদদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে! এবার মাথায় একটা চিন্তা ঘাই মারল। ব্রেক চাপলে যদি বাইক আরও জোরে ছোটে, তা হলে হয়তো উল্টোটাও সত্যি।
পেড়ালে দুপা রেখে বনবন করে ঘুরাতে লাগলাম।
হ্যাঁ, সহসাই ধীর হয়ে এল বাইকের গতি!
ঢাল বেয়ে তখনও নেমে চলেছে বাইকটা, কাজেই নীচে নামা না পর্যন্ত পুরোপুরি থামবে না। তবে গতিটা আমি কমাতে পেরেছি। মিনিট খানেকের মধ্যে ঢিবির নীচে নেমে এসে নিরাপদে থেমে দাঁড়াতে পারলাম।
ঢিবির চূড়ার দিকে চোখ তুলে চাইলাম। ঢোক গিলোম। সবাই দাঁড়িয়ে ঢিবির মাথায়। আমার দিকে চেয়ে তলার উদ্দেশে আঙুল নির্দেশ করছে। হয়তো আমার দুঃসাহসের কথা বলাবলি করছে।
বাইকটাকে হটিয়ে নিয়ে ঢিবি বেয়ে উঠতে লাগলাম।
কিশোর, কী হয়েছিল? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আমরা তো ভেবেছিলাম মারাই যাবে বুঝি। নীচে নামতে গেলে কেন?
কোথায় থামতে হবে বুঝতে পারিনি, বলে মার্কের দিকে চাইলাম। তুমি জিতে গেছ, মার্ক।
তুমি বিপদকে জয় করেছ। তুমিই বিজয়ী, মেট, বলল মার্ক। পরীক্ষায় উতরে গেছ তুমি।
কীসের পরীক্ষা? কার কাছে পরীক্ষা? যে বা যা কাল রাতে মার্কের সঙ্গে কথা বলছিল তার কাছে? এই পরীক্ষার পিছনে কি কোন ধরনের পরিকল্পনা ছিল? এর শেষ কখন, কোথায়? মার্ক কি জানত? জানলেও বলবে না। জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ নেই। আমাকে স্রেফ সতর্ক থাকতে হবে পরের পরীক্ষাটার জন্য।
আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে এই উইকএণ্ডে। মার্ক আর আমি যখন ক্যাম্পিঙে যাব।
শনিবার সকালে ক্যাম্পিঙের জিনিসপত্র গোছগাছ করলাম। পাপ টেণ্ট পরিষ্কার করলাম, স্লিপিং ব্যাগ টান-টান করে নিলাম, গ্যাস ল্যাম্প আর ফ্ল্যাশলাইট পরখ করলাম, চাচীর দেওয়া খাবার আর বেভারেজ প্যাক করলাম।
দুজনের পরনেই জিন্স, সোয়েটশার্ট আর ব্যাকপ্যাক, শনিবার বিকেল নাগাদ তৈরি হয়ে গেলাম আমরা ক্যাম্পিঙের জন্য।
কিশোর, তুই যেহেতু এলাকাটা চিনিস, কাজেই তুই-ই লিডার। এটা নিরাপদ এলাকা। রাতে যখন ক্যাম্প করবি নিরাপদ, শুকনো দেখে একটা জায়গা বেছে নিবি। আর মনে রাখবি ডাকলেই যেন একজন আরেকজনের গলা শুনতে পাস, চাচা পরামর্শ দিল।
মনে থাকবে, চাচা, বললাম।
তোদের ভাল সময় কাটুক, চাচী বলল। দুজনকেই জড়িয়ে ধরল। কালকে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবি কিন্তু, মনে থাকে যেন।
সায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথম কয়েক ঘণ্টা শহরের পিছনের বনভূমি ভেদ করে এগোলাম।
আমাদের দেশে এরকম বন নেই, বলল মার্ক। শেষ বিকেল। বিশ্রাম নিতে থেমেছি আমরা। জঙ্গলের ভিতরে, এক টুকরো ফাঁকা জায়গায় বসেছি দুজনে, লেমোনেড পান করছি।
জানতাম তোমার ভাল লাগবে, বললাম।
আমি আসলে খানিকটা হোমসিক হয়ে পড়েছি, বলল মার্ক। যেদিন এলাম সেদিন জলাভূমির উপর দিয়ে এসেছিলাম। ঠিক আমার অস্ট্রেলিয়ার মত লেগেছিল। ওখানে হাইকিং করলে কেমন হয়, মেট? রাতে আমরা যদি ওখানে ক্যাম্প করি?
জলাভূমি! মার্ক সবচাইতে ভুতুড়ে জায়গাটা বেছে নিয়েছে রাত কাটানোর জন্য।
জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, বললাম।
তাতে সমস্যা নেই। তবু আর ব্যাগগুলো ওয়াটারপ্রুফ। জায়গাটা একনজর দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
ও নীল চোখ মেলে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার দিকে। ভয় পেয়েছি বোঝানো যাবে না। জানি পালিয়ে লাভ হবে না। শোডাউন যদি জলাভূমিতে হয় তো হোক।
কাজেই রাজি হয়ে গেলাম আমি। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। হৃৎপিণ্ড।
অনেকটা পথ হাইক করে জলাভূমিতে পৌঁছতে হলো। দূর থেকে এয়ারপোর্ট চোখে পড়ছে।
তুমি ওখানে ল্যাণ্ড করেছিলে, বললাম।
হ্যাঁ। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। আঁধার হয়ে আসছে। এটা রাত কাটানোর জন্যে চমৎকার জায়গা।
দুটো লম্বা উইলো গাছের মাঝে শুকনো এক স্পট খুঁজে নিলাম আমরা। দূরাগত ব্যাঙের ডাক কানে আসছে। কয়েকটা জোনাকি পোকা উড়ে গেল। এখন গোধূলি, অতটা গা ছমছম করছে না। তবে শীঘ্রিই করবে।