আমি কোন কথা বললাম না। বদলী ছাত্রটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। আমি ঘরে ঢুকেছি টের পায়নি ও। চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে।
মার্ক, ফিসফিস করে ডাকলাম। তুমি ঠিক আছ?
জবাব নেই। আরেকটু কাছিয়ে গেলাম। একচুল নড়েনি মার্ক। আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে যেন জানেই না ও। চোখজোড়া বিস্ফারিত!
মার্ক, তুমি ঠিক আছ? পুনরাবৃত্তি করে, হাত নামিয়ে ওর বাহু স্পর্শ করলাম।
কী ব্যাপার! বলে তড়াক করে সিধে হয়ে বসল ও। এতটাই চমকে গেছি, কয়েক পা পিছু হটে গেলাম।
মার্ক, আমি কিশোর। এই রূম থেকে কথাবার্তার শব্দ পেলাম। মনে। হলো কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে।
চোখ পিটপিট করল মার্ক। উপলব্ধি করলাম আমাকে দেখার পর এই প্রথম চোখের পাতা ফেলল ও। হঠাই ঢিল হয়ে এল শরীর। আবারও স্বাভাবিক দেখাতে লাগল ওকে।
না, কোন গণ্ডগোল হয়নি, মেট, মুচকি হেসে বলল, বিছানা থেকে দোল খাইয়ে নামিয়ে আনল পা জোড়া। মনে হয় কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মার্ক, এঘরে তর্কাতর্কি চলছিল।
ত্বরিত হেসে উঠল ও।
মনে হয় আবারও ঘুমের মধ্যে কথা বলছিলাম। বাবা-মা বলে মাঝেমাঝেই নাকি বলি।
ঘুমের মধ্যে কথা? দুঃস্বপ্ন দেখেছ নাকি?
মনে পড়ছে না। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল মার্ক। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। হাই তুলল। ঘুমানো দরকার, বলল।
আর কথা বাড়ানোর সুযোগ নেই, তাই ওর কামরা ছাড়লাম। তবে এখনও আতঙ্কিত আমি। ওরকম গলা আগে কখনও শুনিনি। মানুষের গলা বলে মনে হয়নি।
কুয়াশার এক কুণ্ডলীকেও মার্কের মুখের চারপাশে ঘুরপাক খেতে দেখেছি। মার্কের বিমান ল্যাণ্ড করার সময়ও আমিই একমাত্র কুয়াশা দেখতে পেয়েছিলাম। হয়তো এসবই আমার কল্পনা!
কিন্তু মার্ক আসার পর থেকে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তো কাল্পনিক নয়। এখনকার ঘটনাটাও যোগ হলো সেগুলোর সঙ্গে।
মার্ক কথা বলছিল। ঘুমের মধ্যে নয় বলেই আমার বিশ্বাস। আরও কেউ একজন কিংবা কিছু একটা ওর সঙ্গে কামরায় ছিল। কে কিংবা কী। সেটা না জানা অবধি সাবধান থাকতে হবে আমাকে। নিজের স্বার্থেই।
পরদিন নাস্তার টেবিলে সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক মনে হলো। অন্তত উপর-উপর।
আজকে শুক্রবার, চাচী বলল। মার্ক, এই উইকএণ্ডে তুমি কি বিশেষ কিছু করতে বা দেখতে চাও?
হ্যাঁ, দেশে আমি অনেক হাইকিং করি। রকি বীচের আশপাশে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং জায়গা আছে। বেড়াতে গেলে মন্দ হত না, জানাল মার্ক।
ভাল তো। কিশোর, এই উইকএণ্ডে মার্ককে নিয়ে হাইকিং করে আয়, চাচী বলল।
গ্রেট আইডিয়া, চাচা যোগ করল। আমাদের কাছে তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক সবই আছে।
চাচা, তুমি যাবে না? প্রশ্ন করলাম।
না, কাজ আছে। প্লাম্বার আর ইলেকট্রিশিয়ান আসবে পাইপ আর তার পরীক্ষা করতে।
ক্যাম্পিঙে গেলে মার্কের ভাল লাগবে। আশপাশে দেখার অনেক জায়গা আছে। তা ছাড়া কিশোর আর তুমি একে অন্যকে আরও ভালভাবে চিনতেও পারবে, উৎসাহ জুগিয়ে বলল চাচী।
মার্কের সঙ্গে ক্যাম্পিঙে যেতে মন সায় দিচ্ছে না আমার। কিন্তু যেতে চাই না বলি কী করে? কী বলব? মার্ক ছেলেটা অদ্ভুত? এই দুর্ঘটনাগুলো ওই ঘটাচ্ছে? আমাকে লক্ষ্য করে এগুলো ঘটানো হচ্ছে? নাহ, কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিশোর, তুই কিছু বলছিস না যে? চাচী জিজ্ঞেস করল। সবাই আমার দিকে চেয়ে।
কথা দিলাম উইকএণ্ডে মার্ককে নিয়ে ক্যাম্পিঙে যাব। খুব মজা হবে। সিরিয়ালের বাইরের দিকে চোখ নামিয়ে মিথ্যে কথাটা বলতে হলো আমাকে।
ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা।
আমরা স্কুলে ঢুকতেই, কয়েকটা ছেলে-মেয়ে আমাদের দিকে ঘুরে চাইল।
অ্যাই, মার্ক, কেমন আছ? মুসা চেঁচিয়ে উঠল।
শার্টটা দারুণ, মার্ক, মৃদু হেসে বলল রবিন।
মার্ক, কাল রাতে বুমেরাং নিয়ে হেভি মজা হয়েছে, বলল শিনা।
মার্ক সবার মনোযোগ পাচ্ছে। নতুনরা পেয়েই থাকে। এতে আমার মন খারাপের কিছু নেই। আমি যদি অস্ট্রেলিয়া যাই, আমাকে নিয়েও মার্কের বন্ধুদের মধ্যে মাতামাতি হবে।
বেল বাজলে যে যার সিটে বসলাম। মিসেস রবার্টস রোলকল করে। সোজা আমার দিকে চাইলেন।
কিশোর, তোমার বুক রিপোর্ট হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন।
জি, মিসেস রবার্টস, জবাব দিলাম।
যার যেদিন বুক রিপোর্ট, তাকে সেদিন ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বই সম্পর্কে বলে যেতে হয়।
ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবার দৃষ্টিনিবদ্ধ আমার দিকে।
মিসেস রবার্ট ডেস্কে বসে টেপ রেকর্ডার অন করলেন। উনি সব সময় আমাদের রিপোর্ট রেকর্ড করেন, পরে যাতে আমরা স্টাডি করতে পারি।
কিশোর আমাদেরকে আমেরিকান বিপ্লবের ওপর পড়া বইটা সম্পর্কে রিপোর্ট করবে, বললেন মিসেস রবার্টস।
গলা খাঁকরে নিলাম। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠল বোঁ করে। ঘরটা বনবন করে ঘুরছে। টলতে লাগলাম।
কিশোর, কিশোর, তুমি ঠিক আছ তো? বলে এগিয়ে এলেন মিসেস রবার্ট। গোটা ঘরটা নাচছে আমার চোখের সামনে। মার্কের নীল চোখে চোখ পড়ল আমার। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। পরমুহূর্তে চারদিক আঁধার হয়ে গেল।
১০
চোখ খুললাম। সব কিছু অস্পষ্ট লাগছে। চোখ পিটপিট করলাম।
কিশোর, এখন কেমন লাগছে? মহিলা কন্ঠে প্রশ্ন এল।
কাউচে শুয়ে আমি। কামরার চারদিকে নজর বুলালাম। স্কুল নার্স, মিসেস ডনেলি আমার উদ্দেশে স্মিত হাসলেন। তাঁর পাশে বসে ডক্টর রিচার্ডসন, চোখের ডাক্তার।