চাচা-চাচী মার্ককে খুঁজছে, এসময় ওদের বিমানের পাইলটকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। দৌড়ে গেলাম তার কাছে।
প্লেনটা ল্যাণ্ড করার সময় লক্ষ করছিলাম আমি। শেষ দিকে কুয়াশা দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আপনি? প্রশ্ন করলাম।
হাসি মুছে গেল ক্যাপ্টেনের। আমার দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মাথা নাড়লেন।
গোটা ট্রিপের কোথাও কোনও কুয়াশা ছিল না।
চোখ পিটপিট করলাম আমি।
কিন্তু আমি তো দেখেছি, বলে জানালা দিয়ে আঙুল নির্দেশ করলাম। আপনি ল্যাণ্ড করার ঠিক আগে কুয়াশার মেঘে ঢুকে পড়েছিল প্লেন।
ক্যাপ্টেন আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
মানুষ এয়ারপোর্টে অনেক উল্টোপাল্টা দেখে। আমি বলছি কোন কুয়াশা ছিল না। হেঁটে চলে গেলেন তিনি।
তাঁর গমনপথের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি দেখেছি, আর কন্ট্রোলে বসে উনি দেখবেন না, এটা হয়? মিথ্যে বলে গেলেন কেন ক্যাপ্টেন?
এসময় আমার নাম ধরে ডাকা হলো।
কিশোর! কিশোর! এদিকে!
ঘুরে দাঁড়ালাম। প্যাসেঞ্জার এরিয়াটায় দাঁড়িয়ে চাচা-চাচী। তাদের পাশে আমার বয়সী এক কিশোর। মার্ক।
এগিয়ে গেলাম। চাচী মার্কের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল।
কেমন আছ, মেট? বন্ধুভাবাপন্ন হাসি হাসল মার্ক। মেট বলতে অস্ট্রেলিয়ানরা বন্ধু বোঝায়।
ভাল। তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম, বললাম। হাত মিলালাম। মার্ক আমার চাইতে খানিকটা খাটো। মাথার চুল হালকা বাদামী, চোখজোড়া ম্লান নীল। একটু যেন উদাসীনও।
প্লেনে বসে থাকতে থাকতে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। লম্বা। জার্নি, বলল ও।
বাসায় যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না, চাচী বলল। রাতে ভাল একটা ঘুম দিলে কাল সকাল থেকেই বছর শুরু করে দিতে পারবে।
তবে তো খুব ভাল হয়, বলে হাই চাপল মার্ক। তোমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে তর সইছে না আমার। শেষের কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলল। গাড়িতে গিয়ে বসেছি আমরা।
ওদেরকে তোমার ভাল লাগবে। মার্ক, একটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়ই, হাই তুলে বলল ও।
প্লেনটা ল্যাণ্ড করার ঠিক আগ মুহূর্তে কী করছিলে তুমি?
আমার দিকে চাইল মার্ক।
কী আর করব? সিট বেল্ট বেঁধে সিটে বসে ছিলাম। কেন?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলে?
হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য।
প্লেনটা কুয়াশার মেঘে ঢুকে পড়েছিল টের পেয়েছিলে?
আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে মার্ক। ওর চোখজোড়া যেন নীলচে দ্যুতি ছড়াল। গাড়ির পিছনের সিট থেকে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে, গা ছমছম করে উঠল আমার।
এবার শান্ত স্বরে বলল ও, না, মেট, কোন কুয়াশা-টুয়াশা চোখে পড়েনি।
মাথা ঝাঁকালাম। বোঝা যাচ্ছে আমি ছাড়া আর কেউ কুয়াশার মেঘটাকে দেখেনি। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?
তবে একটা ব্যাপার ঘটেছিল, মার্ক বলল।
ঝট করে ঘুরে চাইলাম।
কী?
ল্যাণ্ড করার আগের মুহূর্তে প্লেনের বাতিগুলো নিভে যায়। গোটা কেবিন আঁধার হয়ে গিয়েছিল। পরমুহূর্তে আবার আলো ফিরে আসে।
ওহ, হতাশ কণ্ঠে বললাম। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। নাহ, কুয়াশা-রহস্য ভেদ করা গেল না।
ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকল। চাচা গাড়ি পার্ক করলে সবাই নেমে পড়লাম। চাচা-চাচী মার্ককে যখন তার রূম দেখাতে নিয়ে গেল, কিচেনে থমকে দাঁড়ালাম আমি।
কিচেন টেবিলে কিছু কাগজ ফেলে গেছিল চাচা। তার মধ্যে মার্কের পাঠানো একটা চিঠি রয়েছে। ওর একটা রঙিন ছবিও আছে চিঠির সঙ্গে।
ছবিটা তুলে নিয়ে দুমুহূর্ত জরিপ করলাম। ছবির সঙ্গে ওর সব কিছুরই মিল খুঁজে পেলাম। শুধু একটা বাদে। সেজন্যেই গাড়িতে অমন ভয় পেয়েছিলাম আমি, মার্ক যখন তার স্লান নীল চোখ মেলে আমার দিকে চেয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওর চোখজোড়া গাঢ় বাদামি।
৩
পরদিন স্কুল। ঘুমিয়ে উঠে তরতাজা বোধ করছে মার্ক। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল নাস্তার টেবিলে।
কমলার রস আর কর্ন ফ্লেকসে আপত্তি নেই তো? আমরা বেশির ভাগ। দিন সকালে ওগুলো দিয়েই শুরু করি, বলল চাচী।
আমরাও অস্ট্রেলিয়াতে তা-ই করি, বলে সিরিয়ালে চামচ ডোবাল মার্ক।
দুদেশের মিল-অমিল আস্তে আস্তে জানা যাবে, চায়ে দুধ ঢেলে বলল চাচা।
বোধহয় অমিল কম, মিলই বেশি, জানাল মার্ক। অবশ্য আপনাদের এখানে ক্যাঙারু দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
হেসে ফেললাম আমরা। মার্ক নীল চোখজোড়া মেলে আমার দিকে চাইল। চোখ দুটো যেন ঝলসাচ্ছে। হঠাই পানির তেষ্টা পেয়ে গেল। আমার।
যাই, পানি খেয়ে আসি, বলে সিঙ্কের দিকে এগোলাম।
পানি? নাস্তার সাথে? বলিস কী? চাচী বলে উঠল। কোনদিন তো খাস না।
তেষ্টা পেয়েছে কী করব, শ্রাগ করে বললাম। চাচী ঠিকই বলেছে। নাস্তায় সব সময় কমলার রস আর দুধ খাই আমি। কিন্তু এখন আমার পানির খুবই দরকার।
ঠাণ্ডা পানির ফসেট অন করে গ্লাস ভরে নিলাম।
ওউ, পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠে মুখের পানি ফেলে দিলাম সিঙ্কে।
কী হয়েছে! চাচা-চাচী উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল।
পানিটা, কোনমতে আওড়ালাম, ভয়ানক গরম।
ঠাণ্ডা পানি খাবি তো গরম পানি অন করলি কেন? চাচা জিজ্ঞেস করল।
করিনি, বললাম। নীচের ঠোঁটটা অসাড় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে। ফুলে যাবে। কোল্ড ফসেট অন করেছি। এই দেখো।
ফসেটটা আবারও চালু করলাম। সাবধানে আঙুল ছোঁয়ালাম পানির ঝর্নায়। গরম!
এ কী করে হয়? চাচী প্রশ্ন করল। কোল্ড ফসেট থেকে গরম পানি বেরোয় কীভাবে!