পরের বিশটা মিনিট তাঁবু খাটাতে আর ব্যাগ বিছাতে কেটে গেল। এবার ডিনারের ব্যবস্থা করলাম। ফ্র্যাঙ্কস আর বিনস।
মাটিতে বিছানো এক কম্বলের উপর বসেছি দুজনে, নিঃশব্দে ডিনার সারছি। ইতোমধ্যে আঁধার ঘনিয়েছে। প্রদীপ জ্বেলেছি আমি।
মার্ক খাওয়ার সময় একদৃষ্টে প্রদীপের আলোর দিকে চেয়ে রইল। অগ্নিশিখায় স্থির ওর দুচোখ।
আচমকা আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল ও।
ঘুমিয়ে পড়িগে যাই, বলে উঠে দাঁড়াল। তুমি এখন ঘুমাবে নাকি আরও খানিকক্ষণ জেগে থাকবে?
আরেকটু জাগি, বললাম। আসলে প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করছি, কিন্তু মার্ক গভীর ঘুমে তলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে চাই না।
মার্ক তাঁবুতে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকল। ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরে।
আমি বাইরে প্রদীপের আলোর নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকলাম। শান্ত, আরামদায়ক পরিবেশ। এখানে কোন বিপদ হবে না, ভাবলাম। ভুল ভেবেছিলাম। এজায়গাটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরঞ্চ উল্টো-চমৎকার জায়গা। চোখজোড়া ভারী হয়ে আসছে। শিথিল হয়ে আসছে শরীর।
কিশোর, চাপা এক কণ্ঠস্বর কানে এল। অ্যাই, কিশোর, চোখ খোলো।
চোখের পাতা তিরতির করে কেঁপে উঠল। তন্দ্রা কেটে গেছে। কেউ কি ডাকল আমার নাম ধরে?
মার্ক? বলে উঠে বললাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম প্রদীপের পাশে বসে।
মার্ক এখন সচেতন নয়, কিশোর। ও তোমার কথা শুনতে পাবে না। আমি পাব। এবং সেটাই তোমার দরকার।
চোখ পিটপিট করলাম। কণ্ঠটা পরিচিত। মার্ক ওর কামরায় এর সঙ্গেই তর্কাতর্কি করছিল। চোখ তুলে চাইতেই কুয়াশাচ্ছন্ন, ধোঁয়াটে এক অবয়ব দেখতে পেলাম। সারা শরীর ধূসর, শুধু একটা জিনিস বাদে। একজোড়া অন্তর্ভেদী, ঝিকিমিকি নীল চোখ!
১২
পরীক্ষা শেষ, কিশোর। তুমি ভাল করেছ, প্রতিবারই পাস করেছ তুমি। তুমি হবে আমার পারফেক্ট হোস্ট।
তারমানে? কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। কে আপনি? কী আপনি?
কিশোর, তুমি জান আমি কে। আমি ক্যাপ্টেন স্টার। ওরা আমাকে ল্যাণ্ড করতে দেয়নি, কিশোর। আমার আত্মা এতদিন ধরে সুন্দর একটা ল্যাণ্ডিঙের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেই সুযোগ পেয়ে গেছি আমি। তুমি আমার আত্মাকে তোমার দেহে ধারণ করবে। তুমি হবে আমার হোস্ট, আবারও বলল ছায়ামূর্তিটা।
তাঁবুর দিকে পিছিয়ে গেলাম। কুয়াশাময় জিনিসটার দিকে চোখ সেঁটে আছে আমার। কিন্তু ক্রমেই সরে যাচ্ছি আমি ইঞ্চি-ইঞ্চি করে।
আপনি মার্কের শরীরের ভিতরে ছিলেন, তাই না? প্রশ্ন করলাম। ছায়াময়কে কথা বলিয়ে সময় পেতে চাইছি।
হ্যাঁ, সেদিন ওর প্লেন যখন কুয়াশার মধ্যে ঢুকল তখন ওর দেহে প্রবেশ করি আমি। ওকে ব্যবহার করে আমি তোমার কাছে আসি। তোমাকে পরীক্ষা করে দেখি, তুমি আমার উপযুক্ত মেজবান হতে পারবে কিনা। তুমি প্রতিটা পরীক্ষায় পাস করেছ, কিশোর। খলখল করে হাসল, ওটা। তোমাকে দিয়ে উল্টোপাল্টা কাজ করিয়েছি। তোমার সাথে উল্টোপাল্টা ব্যবহার করা হয়েছে। ঠাণ্ডা পানির বদলে গরম পানি, এয়ারকণ্ডিশনার থেকে গরম বাতাস বেরনো-এসবের কথা বলছি। তুমি প্রতিটা পরীক্ষায় উতরে গেছ। শেষমেশ পেডাল মেরে বাইক পর্যন্ত থামিয়ে ফেলেছ। হবে, কিশোর, তোমাকে দিয়ে হবে!
আপনি আমাকে আপনার আত্মার হোস্ট বানাতে চান কেন? জিজ্ঞেস করলাম। আমি থমকে দাঁড়িয়েছি ব্যাকপ্যাকের কাছে। ওটা আমার পিছনে। ডান পায়ের পিছনের অংশ ছুঁয়ে আছে ব্যাকপ্যাকটাকে।
কারণ আমি শেষ পর্যন্ত ল্যাণ্ড করতে চাই, কিশোর। তোমার শরীরে প্রবেশ করে, তোমার মন আর আত্মাকে দখল করে আমি সুযোগটা পেতে চাই! আমি কিশোর পাশা বনে যাব। সবাই যাকে ভালবাসে। আমরা দুজনে মিলে সবার উপরে প্রতিশোধ নেব। এই শহর বহু বছর আগে আমার সাথে যা করেছে তার প্রতিশোধ!
ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকাচ্ছি আমি।
ওরা বহু বছর আগে আপনার সাথে কী করেছিল, ক্যাপ্টেন স্টার? জবাব চাইলাম। আমার কণ্ঠস্বর জোরাল শোনালেও শব্দগুলো মুখ থেকে বের করতে কষ্ট হলো-দাতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে।
ওরা আমাকে ল্যাণ্ড করতে দেয়নি! আর এই কুয়াশা আমার শরীর দখল করে নেয়। আমাকে বন্দি করে, আকারহীন, অবয়বহীন এক অস্তিত্বে পরিণত করে। নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছ! চেঁচিয়ে উঠল ওটা।
মায়াই লাগল ওটার প্রতি। কিন্তু তাই বলে ছায়ামূর্তিটার ধারক হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার। এখন, রক্ষা পাওয়ার একটাই মাত্র উপায়। সরাসরি ওটার চোখের দিকে চাইলাম।
ঠিক আছে, আমি রাজি, বললাম।
ধন্যবাদ, কিশোর। দখলের জন্যে প্রস্তুত হও। আমাদের দীর্ঘ প্রতিশোধপরায়ণ জীবন শুরু হোক!
নীল চোখজোড়া ধকধক করে জ্বলছে। কুয়াশা পাকিয়ে উঠে সোজা, সরু এক স্তম্ভে রূপ নিয়েছে। আমার দিকে পাক খেয়ে নেমে আসছে এ
কোন ভুল-চুক করা চলবে না।
আমার হাতে এক কি দুই সেকেণ্ড মাত্র সময়।
কুয়াশা চেপে আসছে আমার উপরে। আর মাত্র কফুট বাকি, এখুনি মাথা ছুঁয়ে ফেলবে!
ব্যাকপ্যাক থেকে এক টানে ফ্ল্যাশলাইটটা বের করলাম। পরমুহূর্তে সুইচ টিপে সোজা তাক করে ধরলাম আগুয়ান কুয়াশার কুণ্ডলীটার উদ্দেশে।
না! করুণ চিৎকার উঠল। আলোয় ধরা পড়েছে কুয়াশা। আলোর রশ্মি ধরে রেখেছি, ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে লাগল ওটা। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। শেষ অবধি রইল শুধু অল্প একটুখানি ধোঁয়া আর একজোড়া তীক্ষ্ণ, নীল চোখ। চোখজোড়া আমার দিকে শেষবারের মত অগ্নিদৃষ্টি হেনে আবছা কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।
১৩
কী ভেবে ফ্ল্যাশলাইট অন করলে, মেট? মার্ক জানতে চাইল।