ঘরটা লম্বায় অন্তত একশো পঞ্চাশ ফুট হবে। চওড়াতেও তার কম নয়। সিমেন্টের মেঝেতে সরু সরু আঁকাবাঁকা ফাটল ধরেছে। পুরু হয়ে ধুলো জমেছে ঘরের ভিতর। খেয়াল করতেই ওরা দেখতে পেল, ঘরটার মাঝখানে বামদিকে একটা পথ আছে। ওখান থেকে আলোর আভা আসছে।
চাকার দাগ ওদিকেই গেছে, বলল কিশোর।
গাড়ির চাকার ছাপগুলো নোটবুকে হুবহু এঁকে নিল রবিন, তারপর ওদিকটা লক্ষ করে এগোল দুজন।
সাবধানে থাকতে হবে, নিচু স্বরে বলল রবিন। যথেষ্ট সময় পেয়েছে লোকটা। হয়তো ডাণ্ডা নিয়ে তৈরি হয়ে আছে, দুই বাড়িতে ঠাণ্ডা করে দেবে আমাদের।
আস্তে করে মাথা দুলিয়ে সায় দিল কিশোর, তারপর নীরবে ইশারা করল। কিশোর কী বলতে চায় বুবাতে অসুবিধা হলো না রবিনের, নিঃশব্দে ওয়্যারহাউসের ডানদিকের দেয়ালের পাশে সরে গেল ও। সাবধানে এগোচ্ছে আলোর আভা আসা বাকটার দিকে।
এদিকে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর। কিছু একটা শুনতে পেয়েছে ও। মনে হলো যেন আঁচড়াচ্ছে কেউ। ভ্রূ কুঁচকে উঠল কিশোরের। রাফিয়ান নাকি?
কিশোর থামতেই রবিনও থেমে দাঁড়িয়েছে। একই আওয়াজ ওর কানেও গেছে। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।
মনে মনে দশ গুনল কিশোর, আর কোনও আওয়াজ শুনতে পেল না। আঁচড়াচ্ছে না আর কেউ। নিঃশব্দে বাঁক ঘুরল কিশোর। রবিনও ওর ঠিক পিছনেই আছে।
এদিকে আরেকটা খোলা দরজা। ওটা দিয়ে আসা উজ্জ্বল আলোয়। ক্ষণিকের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওদের। সামলে নিয়ে দেখল, এদিকেও ধূসর গাড়িটার চিহ্নমাত্র নেই। রাফিয়ানকেও দেখা গেল না। ওয়্যারহাউসের এই অংশটাও ফাঁকা একটা ঘর। ওয়্যারহাউসের ধুলোভরা মেঝে আর তাতে চাকার দাগ ওদের নীরবে বলে দিল কী ঘটেছে। এক দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে কুকুর-চোর।
এলাকাটা চেনে লোকটা, বলল কিশোর, নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। এই ওয়্যারহাউসটা সম্বন্ধেও জানে।
জানত এভাবে হয়তো আমাদের ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব, বলল রবিন।
এই ওয়্যারহাউসটা কাদের সেটা জানতে হবে।
একটা জিনিস রবিনের চোখে পড়েছে। উবু হয়ে ওটা তুলল ও, কিশোরকে দেখাল। ইংরেজি এস-এর মতো একটা বাঁকানো হুক। জিজ্ঞেস করল, কী হতে পারে?
কুকুরের লাইসেন্স আটকানো হয় এধরনের হুক দিয়ে, বলল কিশোর। আমার বাঘারও আছে এরকম একটা। রবিনের কাছ থেকে নিয়ে জিনিসটা বুক পকেটে পুরল ও। তারপর বলল, আওয়াজটা শুনেছ না? ওই যে আঁচড়ানোর আওয়াজ? ওটা কোত্থেকে এলো?
গাড়ির শব্দ শুনতে পেল ওরা। এঞ্জিনের দিক-ঢ়িক-চিক-চিক আওয়াজটা ওদের বলে দিল মুসা আসছে ওর ফোক্সওয়াগেন নিয়ে। প্লাগগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছে। কচ্ছপের গতিতে বাঁক ঘুরল মুসা, হেডলাইটের ম্লান আলোয় ওদের দেখতে পেয়ে থামল। ও গাড়ি থেকে নামতেই কী ঘটেছে জানাল ওরা।
আঁচড়ানোর আওয়াজটা ইঁদুরের হতে পারে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মনে হয় না, একটু ভেবে উত্তর দিল কিশোর। দরজার পাশে একটা অফিসের দিকে হাত তুলল ও। এক সময় ওটা ম্যানেজারের অফিস ছিল। পোকায় কাটা দরজায় এখনও ম্যানোর লেখা আছে, বাকিটা ঘুণ পোকা খেয়ে ফেলেছে। ওখানে খুঁজে দেখা দরকার। তোমরা দেখো গাড়িটা কোনদিকে গেছে আন্দাজ করতে পারো কি না।
চাকার দাগ অনুসরণ করে এগোল মুসা আর রবিন। কিশোর চলল। অফিসটার দিকে।
দরজার নবে মোচড় দিল কিশোর। তালা খোলাই আছে। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল কিশোর। ঘরটায় গা ছমছমে গাঢ় অন্ধকার। জানালাগুলো পেরেক আর তক্তা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিশোর ঢুকতেই ঘড়ঘড় আওয়াজ করে উঠল একটা কুকুর।
রাফিয়ান? মৃদু স্বরে ডাকল কিশোর।
গর্জনটা থেমে গেল।
রাফিয়ান? আবার ডাকল কিশোর।
সাবধান! খানিকটা দূর থেকে সতর্ক করল রবিন। ফিরে এসেছে। ও। রাফিয়ান কখনও এভাবে গর্জায় না।
দেয়াল হাতড়ে বাতির সুইচ খুঁজল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসে নিশ্চয়ই ইলেক্ট্রিসিটির কানেকশন অনেকদিন আগেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। একটা পায়া-ভাঙা চেয়ারে হোঁচট খেল কিশোর। আবার গর্জনটা শুনতে পেল। এবার অনেক কাছে! দরজা দিয়ে আসা আবছা আলোয় দেখতে পেল…
ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে ওটা। বিরাট একটা কুকুর। আলো পড়ে ওটার হলদে চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। দাঁত খিঁচিয়ে গর্জে উঠল আবার। আতঙ্কের স্রোত টের পেল কিশোর, মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা কিছু যেন নেমে যাচ্ছে। কুকুরটা রাফিয়ান নয়!
মস্ত এক পিট বুল!
হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে সামনে বাড়ল হিংস্র জন্তুটা। পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করল কিশোর, কিন্তু চেয়ারটায় আবার হোঁচট খেলো। পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে।
কুকুরটার বড় বড় ঝকঝকে দাঁতগুলো অল্প আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাল। একেবারে শেষ মুহূর্তে কিশোর বুঝতে পারল, ওর গলা লক্ষ্য করে লাফিয়ে উঠছে কুকুরটা! নাগালে পেলেই এক কামড়ে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলবে!
দুহাতে গলা বাঁচাতে চেষ্টা করল কিশোর।
৩
কুকুরটা দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠতেই ঝাঁকি দিয়ে মাথাটা পিছনে সরিয়ে নিল। ও। ওর গলায় কামড় বসাতে পারল না পিট বুল, তবে হাতে ওটার দাঁতের স্পর্শ পেল কিশোর। যে-করে হোক ঠেকাতে হবে ভয়ঙ্কর জন্তুটাকে।
পিট বুল কাছে চলে আসায় ওটার গলাতে একটা মজবুত চেইন কলার দেখতে পেল ও। জানোয়ারটা মাটিতে পা নামিয়েই আবার দুপায়ে খাড়া হয়ে উঠল। ওটার লক্ষ্য কিশোরের কণ্ঠনালী।