- বইয়ের নামঃ কালঘুম
- লেখকের নামঃ শামসুদ্দীন নওয়াব
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
কালঘুম
১
কিশোর জোর এক চটাশ! শব্দের সঙ্গে কাৎরে উঠতেই চমকে গেল মুসা। ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। কী হলো?
চেহারা বিকৃত করে খসড়-খসড় শব্দে গোড়ালি চুলকাল কিশোর। বলল,
নমরুদের বিপক্ষের সৈন্যরা জ্বালাচ্ছে বড়।
কুঁচকে উঠল মুসার। বুঝতে পারেনি। কারা?
মশা!
মশা? বিস্মিত হলো মুসা। মশা কামড়ালে অমন চেঁচিয়ে উঠতে হবে? আমি তো মশাকে পাত্তাই দিই না!
বিড়বিড় করে বলল কিশোর, পাত্তা ঠিকই দাও, কিন্তু এখন স্বীকার করবে না। বন্ধুর দিকে তাকাল। নাও, চাল দাও।
বোর্ডের দিকে হতাশ চোখে তাকাল মুসা। কালো নিয়ে খেলছে, অবস্থা। কাহিল। কোনটা চালবে বুঝতে পারছে না। হাতি, নৌকা, ঘোড়া সব একটা করে আছে। সৈন্য মোটে তিনটে আছে, আর সব ফরসা করে দিয়েছে। কিশোর। অথচ ও নিজে কিশোরকে তেমন বাগেই পায়নি। একটা ঘোড়া, একটা হাতি আর দুটো সৈন্য খেয়েছে কেবল।
ওর রাজাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে কিশোর। ঠুটো জগন্নাথের মত অবস্থা রাজার, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। একটু ভুল করে বসলেই বারোটা বাজিয়ে দেবে কিশোর। মাত হয়ে যাবে ও।
দাবা চমৎকার খেলে কিশোর। ওদের পাড়ার অনেকের মধ্যে ও সেরা, কেউ কখনও হারাতে পারেনি। মুসা প্রায়ই চেষ্টা করে সে-রেকর্ড ভাঙার, সময় পেলেই ওকে ধরে নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। মুসার রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল, আজও। এরইমধ্যে কম করে হলেও অন্তত পঞ্চাশবার হেরেছে ও। আজও সেই অবস্থা। মুসার ধারণা কিশোরের জটিল মাথায় কুটিল ষড়যন্ত্র চলছে ওকে ফাসাবার। সুযোগ খুঁজছে ও। পেলেই গা করে চেপে ধরবে।
একটা বদ স্বভাবও আছে তিন গোয়েন্দা প্রধানের। খেলার সময় প্রতিপক্ষকে চাল দেয়ার আগে ঠিকমত চিন্তা ভাবনার সুযোগ দেয় না। নিজের চালের সময় মিনিটের পর মিনিট মাথা খাটায়, অথচ প্রতিপক্ষকে এক মিনিট ভাবতে দেখলেই আপত্তি তোলে। সব সময়।
হয়তো ওর সন্দেহ প্রতিপক্ষকে বেশি চিন্তার সুযোগ দিলে ও হেরে যাবে। আসলে কিন্তু তা নয়। কিশোরকে প্রায় কখনোই হারতে দেখেনি ওরা কেউ। তবু ওই বদকম্মটা করাই চাই। এই যেমন এখন মশার কথা তুলে বাগড়া দিল, এরপর আবার কী করে বসে কে জানে!
কী হলো, চাল দাও! তাড়া লাগাল কিশোর। ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটাই চালল মুসা। আড়াই ঘর চাল দিয়ে ওটাকে মন্ত্রীর সহজ টোপে পরিণত করল।
যদি ওটা খেয়েই বসে, তা হলে খবর আছে কিশোরের। তবে মনে হয়।, তেমন কিছু ঘটবে। ওটা যে ফাঁদ, কিশোর বোধহয় বুঝতে পারবে। ঘটলও তা-ই, ওদিকে তাকালই না পাজিটা।
বরং মন্ত্রী এগিয়ে নিয়ে এল ওর, ঠুটো জগন্নাথ রাজার দিকে। আরও কোণঠাসা করে ফেলল। মনে মনে জিভ কাটল মুসা। কিশোরের জন্য ফাঁদ পাতার আগে বরং একটা কিছু এনে রাজাকে আড়াল দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। অন্য পথ দেখতে হবে। মাথা চুলকাতে লাগল মুসা।
তোমার আগের ঘরটা বড় ছিল, বলল কিশোর। এত ছোট ঘরে থাকছ কী করে? দম বন্ধ হয়ে আসে না?
চোখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকাল মুসা। তারপর নজর বোলাল পিচ্চি রুমের উপর। ঘরের ব্যাপারে মিথ্যে বলেনি কিশোর। সত্যিই ঘরটা খুবই ছোট। দশ বাই দশ। একটা সিঙ্গেল খাট, পড়ার টেবিল, চেয়ার ও ক্লজিট–এতেই ভরে গেছে। নড়াচড়া করার জায়গা নেই। একটু বেখেয়াল হলে এটা-ওটার সঙ্গে ঠোকর খেতে হয়। কয়েকবার পেটে গুঁতো লেগে খুব ব্যথা পেয়েছে ও। কখনও দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমি যেমন, আমার রুমও তেমন, এমনই তো হবে, গম্ভীর চেহারা করে হাতি দিয়ে ওর একটা সৈন্য খেয়ে নিল মুসা। অসুবিধে হয় না। গত কয়েকদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে। মা বলেছে পরে কোনও বড় রুম দেয়া হবে আমাকে। কিশোরের দিকে ঝুঁকে এল মুসা। ভাল করে দেখো তো, গোঁফের রেখা ফুটেছে আমার?
কিশোর ওর দিকে তাকাল। ঠোঁট মুড়ে হাসল কেবল, কিছু বলল না। তারপর খেলায় ডুবে গেল আবার। কয়েক মুহূর্ত পর নৌকো দিয়ে মুসার একমাত্র ঘোড়াটা খেয়ে বলল, চেক, এবার সামাল দাও দেখি।
এই ভয়টাই করছিল মুসা। হার হলো আজও। তিন গোয়েন্দা প্রধানের। সঙ্গে দাবায় কখনোই এটে উঠতে পারে না ও। সত্যিই খেলতে পারে কিশোর! গেল বার সাব-জুনিয়র জাতীয় প্রতিযোগিতায় এক পয়েন্টের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
কিশোর উঠে দাঁড়াল। আজ নিয়ে কবার হারলে, মনে আছে?
কাল এসো, কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলল মুসা। ঠিকই তোমাকে হারাব।
আসব, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় উদয় হলো আরেকটা মুখ।
মুসার মামাত বোন, তানজিয়া। হ্যালো, মিস্টার মুসা, দাবা-জগতের ভবিষ্যৎ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, কেমন আছ?
রাগিয়ে না তানজিয়া, একটু রেগেই গেল মুসা। একদিন ঠিকই তা-ই হব আমি, নিশ্চিত থাকতে পারো।
বেশ-বেশ, আমরাও চাই তুমি তা-ই হয়ে বিশ্বে হইচই ফেলে দাও।
তানজিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল শাওনি, ওর ফুপাত ভাই। প্রায় তানজিয়ারই সমবয়সী।
মুসার এই খালাত ভাই ও মামাত বোন এবছরটা থাকবে ওদের বাড়িতে। বড়রা আলাপ করছেন, ওদের রকি বিচ স্কুলেই ভর্তি করা হতে পারে। হয়তো, সেজন্যই তানজিয়া পেয়েছে ওর আগের ঘরটা। বাড়তি ঘর দুটোর একটায় উঠেছে শাওনি। তাতেই মুসার মনে দাগা লেগে গেছে। নিজে ও বাধ্য হয়ে থাকছে ইঁদুরের এই গর্তে।