জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে আছে কিশোর রবিন। ঝট করে ঘুরল মুসা ওরা কী দেখছে বোঝার জন্য। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল।
রবিন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে উঠল, নিয়ে গেল!
হ্যাঁ, নিয়েই যাচ্ছে বটে! দুহাতে রাফিয়ানকে জাপ্টে ধরে তুলে নিয়ে ছুটছে এক হালকা-পাতলা লোক। রাবারের মুখোশ পরে আছে সে, চেহারা দেখার উপায় নেই। এক পলকে যেন উড়ে বেরিয়ে গেল, লোকটা ইয়ার্ডের দরজা দিয়ে।
চলো! তাগাদা দিল কিশোর। জানালা টপকে নীচে নেমেই ছুটতে শুরু করল ও। পলকের জন্য ভাবল, বাঘা কেন পিছু নিচ্ছে না। কিশোরের পিছনে দৌড় দিল রবিন আর মুসা। তিনজনই প্রাণপণে
ছুটছে। না, ইয়ার্ডের গেট পেরিয়ে, থমকে দাঁড়াল ওরা। একরাশ ধুলো উড়িয়ে রওনা হয়ে গেছে পুরোনো একটা ধূসর গাড়ি। ওটার একটা দরজা হলদে রং করা। ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে, তারপর বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটা! রাফিয়ানের ভউ-ভউ অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে!
২
এক দৌড়ে মুসার ফোক্সওয়াগেনের কাছে ফিরে এলো ওরা, দেরি না করে লাফ দিয়ে চড়ে বসল। ছুটল ওরা কুকুর-চোরের পিছনে। বড় রাস্তায় উঠে ধূসর গাড়িটার মতোই বামদিকের বাঁক ঘুরল মুসা। স্টিয়ারিং হুইলের উপর ঝুঁকে বসেছে ও। সহজে কুকুর-চোরকে হারাতে চায় না বলে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
ওই যে! দূরে ধূসর গাড়িটা দেখতে পেয়ে বলে উঠল রবিন। আবার বাঁক নিচ্ছে!
আধ মিনিট পর বাঁক নিল মুসাও। ধূসর গাড়িটা ওদের কয়েকশো গজ সামনে। হলুদ দরজাটা বেমানান লাগছে এতোটা দূর থেকেও। দরজাটা বোধহয় কোনও জাঙ্ক ইয়ার্ড থেকে সগ্রহ করেছে, মন্তব্য। করল মুসা।
গাড়ি যেমনই হোক, ওটায় বিল্ট-ইন কার-ফোন আছে, বলল কিশোর। গাড়ির পিছনের অ্যান্টেনাটা দেখা যাচ্ছে। হাইওয়ের দিকে যাচ্ছে লোকটা।
অ্যান্টেনাটা দেখতে পাচ্ছি, বলল, মুসা। একটা ধীরগতির ডেলিভারি ট্রাক পাশ কাটাল ও।
ধূসর গাড়িটা ঢালু রাস্তার একটা অংশ পেরিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের দিকে চলেছে।
দূরত্ব কমছে, জানাল মুসা।
একেবারের বামদিকের লেনে সরে গেল ধূসর গাড়ির কুকুরচোরা ড্রাইভার। দুপুর এখন। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড়। তবুও তাকে হারাল না মুসা। ধূসর গাড়ি থেকে আর দুটো গাড়ি পিছনে আছে ওরা এখন।
চাকার তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে হঠাৎ ডানদিকে সরে গেল ধূসর গাড়ি।
সামনের ওই রাস্তা পার হওয়ার আইল্যান্ড-ছাড়া জায়গাটার দিকে যাচ্ছে, ফোক্সওয়াগেনের এঞ্জিনের গর্জনের উপর দিয়ে বলল মুসা। দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে অনুসরণ করল ও ধূসর গাড়িটাকে।
লাইমস্টোন স্ট্রিটে পড়ল এবার ওরা। দুপাশে বন্ধ ওয়্যারহাউস আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাড়িঘর। বন্দরের দিকে চলেছে ওরা। জায়গাটা বিশেষ সুবিধার নয়। চুরি-ডাকাতির জন্য কুখ্যাত।
গাড়ির গতি কমাল মুসা। লোকটা দুব্লক সামনে ডানদিকে মোড় নিয়েছে।
একটু পরই মোড়টা ঘুরল ওরাও।
একটা পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসের খোলা দরজা দিয়ে ধূসর গাড়িটাকে ঢুকে যেতে দেখল তিন গোয়েন্দা। আর ঠিক তখনই খকখক করে কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল ফোক্সওয়াগেনের এঞ্জিন।
যাহ! হতাশ গলায় বলল মুসা, আবার প্লাগে, ময়লা চলে এসেছে।
বা তুমি প্লাগ পরিষ্কার করে এসো, আমরা লোকটার পেছনে যাচ্ছি। গাড়ি থামতেই নেমে পড়ল কিশোর। রবিন আর ও এগোল ওয়্যারহাউসটার দিকে।
দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ নেই ওয়্যারহাউসে, কাছাকাছি পৌঁছে। মন্তব্য করল রবিন।
গোটা এলাকাই পরিত্যক্ত, সায় দিল কিশোর। ওদের পাশ কাটাল ময়লা কাপড় পরা এক লোক, সজিভরা ঠেলাগাড়ি নিয়ে বাজারে চলেছে।
ওয়্যারহাউসের ফটকটা বিশাল। দরজাটা টেনে নামিয়ে বন্ধ করা হতো। এখন উপরে তুলে রাখা হয়েছে। খোলা দরজাটাকে হাঁ করা। দৈত্যের কালো মুখ-গহ্বরের মতো লাগল।
নিশ্চয়ই ভেতরে আছে লোকটা, বলল রবিন। আমাদের যাওয়া কি ঠিক হবে? হয়তো অন্ধকারে আমাদের ধরার জন্যেই খাপ পেতে বসে আছে।
ঠিকই বলেছ, বলল কিশোর। আগে চলো বাইরে থেকে একবার। ঘুরে দেখি জানালা দিয়ে কিছু দেখা যায় কি না, তারপর ঢুকব।
দরজার এক ফুট দূরে দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াল কিশোর, তারপর সরতে শুরু করল একদিকে। রবিন একবারও দরজার দিকে না তাকিয়ে পার হয়ে গেল ওটা, তারপর কিশোরের মতোই দেয়াল ঘেঁষে অন্যদিকেচলল।
ওয়্যারহাউসের বেশিরভাগ জানালারই কাঁচ ভাঙা। একটা আস্ত জানালার উপরে রকি বিচ স্টোরেজ লেখা অস্পষ্ট সাইনবোর্ড দেখতে পেল রবিন।
ওদের পরিকল্পনায় কোনও লাভ হলো না। ভিতরটা অন্ধকার। বাইরে দিনের উজ্জ্বল আলো আছে বলে জানালাগুলো দিয়ে কিছুই দেখতে পেল না ওরা। আবার দরজার কাছে ফিরে এলো দুজন। বুঝতে পারছে, মুসা থাকলে আরেকটু ভরসা পাওয়া যেত।
কোনও আওয়াজ তো পাচ্ছি না, ফিসফিস করল রবিন।
দরজার কোনা থেকে সাবধানে উঁকি দিল কিশোর, ধুলোর মধ্যে প্রাচীন গাড়িটার চাকার দাগ দেখতে পেল। ঠোঁটে আঙুল তুলে রবিনকে সতর্ক করে ভিতরে পা বাড়াল কিশোর! রবিনও চলে এলো ওর পাশে। দুজনই হুশিয়ার হয়ে আছে, যাতে আওয়াজ না হয়।
চোখ সয়ে আসতেই জানালা দিয়ে যে আলো আসছে সেই আবছায়ায় ওরা দেখতে পেল ভিতরে কেউ নেই। গাড়িটা বিরাট ঘরের কোথাও দেখা যাচ্ছে না।