পার্কিং লট পার হচ্ছে রবিন, হাতে মানিব্যাগ। কিশোরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে যাচ্ছে ও। অন্য কোথাও ওকে দেখা করতে বলেছে ডগন্যাপার।
কিশোর অস্বস্তি নিয়ে দেখল, সিঁড়ি বেয়ে অবর্ভেশন ডেকে উঠছে রবিন। ওখানে সমুদ্রের উপর বেড়ে থাকা একটা কাঠের প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপণ আর বন্দিবিনিময় হবে। তখন অন্তত চারশো ফুট উঁচতে থাকবে। রবিন। নীচে রুক্ষ পাথুরে সৈকত। মুসা বের হলো এবার গাড়ি থেকে। ছায়ায় মিশে নিঃশব্দে রবিনের পিছু নিয়ে চলেছে সে। অপেক্ষা করল কিশোর।
ডগন্যাপারের দেওয়া কাগজে লেখা আছে রবিনকে অব্যার্ভেশন ডেকে যেতে হবে। সেদিকেই চলেছে মুসাও। সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। চোর! ট্র্যান্সমিটারে রবিনের চিৎকার শুনতে পেল কিশোর। মুসাকে দৌড় দিতে দেখল। আপনি বলেছিলেন রাফিয়ানকে ফেরত দেবেন!
ঝড়ের বেগে ছুটছে মুসা, দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করল। দেরি করল না কিশোরও, দৌড় দিল অবর্ভেশন প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি লক্ষ করে। আহ্! রবিনের আর্তচিৎকার শুনতে পেল। তার পরপরই ট্রান্সমিটারের কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
অন্ধকার পার্কটা যেন ভুতুড়ে, চারপাশে আর কোনও শব্দ। মুসাকেও দেখা যাচ্ছে না। সিঁড়ি টপকে প্ল্যাটফর্মে উঠে গেছে ও। জুতোর ফিতে খুলে যাওয়ায় হোঁচট খেল কিশোর। ওগুলো বাঁধতে গিয়ে। বেরিয়ে গেল মূল্যবান একটা মিনিট। আবার ছুটল ও সিঁড়িগুলোর দিকে। তারপর মত পাল্টাল। ঘুরপথে ছুটল সৈকতের দিকে। ওদিক থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠবে। দুদিক দিয়ে তা হলে ঘিরে ফেলা যাবে কুকুর চোর লোকটাকে।
.
ওদিকে প্ল্যাটফর্মের উপর উঠে পড়েছে মুসা। আগেও এখানে এসেছে। কয়েকবার। তবে সবসময় এসেছে দিনে। কিন্তু এখন চারপাশে ঘন কুয়াশার রাজত্ব। এক হাত সামনেও দেখা যায় না। রবিনের অস্ফুট কথা শুনেছে মুসা, বুঝতে পারছে বিপদে পড়েছে রবিন। ওর সাহায্য দরকার। কিন্তু কোথায় রবিন? সাদা কুয়াশার দেয়ালের কারণে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। কোনও আওয়াজও নেই।
রবিন? ডাকল ও। এখন আর ওদের পরিকল্পনা কাজে আসবে না। রবিন?
প্ল্যাটফর্মের কিনারায় চলে এসেছে ও, আরেকটু হলেই নীচে পড়ত, একেবারে শেষ সময়ে সামলে নিল। এদিক দিয়ে আরেক প্রস্থ সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকতে।
জবাব দিল না রবিন।
আরও কয়েকবার ডাকল মুসা, সাড়া নেই কোনও।
গা ছমছম করা নীরবতা। শিউরে উঠল মুসা। এই একটু আগে প্ল্যাটফর্মের উপর দুজনের উপস্থিতি টের পেয়েছে ও। রবিন আর ডগন্যাপার কোথায় গেল?
.
নিস্তব্ধ সৈকত। নির্জন। এতো রাতে কেউ নেই আর। প্ল্যাটফর্মে ওঠার সিঁড়িটা খুব সরু। ওটার কাছে পৌঁছে একটু থামল কিশোর। টর্চ জ্বেলে বালিতে পায়ের ছাপ দেখল। কোনওটাকেই নতুন মনে হলো না। তা হলে কি এদিক দিয়ে নামেনি এখনও ডগন্যাপার আর রবিন-মুসা? সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে এলো ও। কুয়াশার কারণে নিজেকে ওর প্রায় অন্ধ বলে মনে হচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরে একটা আওয়াজ শুনতে পেল। থমকে দাঁড়াল কিশোর। টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। রবিন না মুসা করল আওয়াজটা?
একটা অস্ফুট চিৎকার ভেসে এলো কুয়াশার ভিতর থেকে। রবিন? মুসা? গলা কেঁপে গেল কিশোরের।
কিশোর? আমি এখানে। মুসার গলা। কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা ছায়ামূর্তি।
রবিন কোথায়?
জানি না, হাঁফাচ্ছে মুসা। ডগন্যাপারের সঙ্গে ছিল। তারপর কোনও গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
সব গোলমাল হয়ে গেল, বলল বিব্রত কিশোর। রাফিয়ানকে তো আমরা ফেরত পাই-ইনি, এখন রবিনও নিখোঁজ!
চোরটা নিশ্চয়ই রবিনকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেনি, বলল মুসা। এক কাজ করি এসো, তুমি প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকটা দেখো, আমি যাচ্ছি দক্ষিণ দিকটা খুঁজতে।
মানসিক ভাবে দুর্বল বোধ করছে মুসা, যতোই জোর দিয়ে কথা বলুক না কেন। পার্শ্ববর্তী টিলার সারিতে দুবার খুঁজেছে ও, রবিনের চিহ্নও দেখেনি। কিছু ফেলে যায়নি রবিন সূত্র হিসাবে। ওকে যে ধরে নিয়ে গেছে সে-ও কোনও চিহ্ন ছাড়াই উধাও হয়েছে। কিশোর চলে যাওয়ার পর একটা কথা মনে এলো ওর। রবিন কোথায় থাকতে পারে
এখন মনে হয় আন্দাজ করতে পারছে ও। এ গুহা! রকি বিচের টিলাগুলোতে গুহার কোনও অভাব নেই। ওগুলোর একটাতে হয়তো লুকিয়ে আছে রবিন। হয়তো ডগন্যাপারের হাতে ধরা পড়েনি ও।
এ্যানিটের টিলায় উঠবার সহজ একটা পথ খুঁজতে শুরু করল মুসা। বামদিকে টিলার গায়ে ঝোপের ভিতর দিয়ে সরু একটা পথ আছে। যদি অবশ্য চোখের ভুল না হয়। ওদিকে এগোল ও। ঠিক তখনই পিছনে একটা আওয়াজ শুনতে পেল। বন্যার স্রোতের মতো স্বস্তি অনুভব করল ও অন্তরে। নিশ্চয়ই রবিন।
মুসা ঘুরবার আগেই, একটা লোহার চেইন ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল। পিছন থেকে কেউ জোর টান দিচ্ছে। ভারসাম্য হারাতে শুরু করল মুসা। গলায় শক্ত হয়ে চেপে বসছে চেইনটা। শ্বাস আটকে আসছে। দুহাতে চেইনটা গলা থেকে ছোটাতে চেষ্টা করল ও। আর তখনই একটা রুমাল চাপ দিয়ে ধরা হলো ওর নাকে। রুমালটায় কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ। ছুটতে চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভারি আচ্ছন্ন বোধ করল মুসা। চোখের সামনে দুনিয়াটা যেন চরকির মতো ঘুরছে। জ্ঞান হারাবার আগে ওর শেষ চিন্তা এলো, টিলা থেকে পড়ে গেলে মরতে হবে। তারপরই অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ল ও।
১৩
প্ল্যাটফর্মের উত্তর প্রান্তে চলে এসেছে কিশোর, কোনও লাভ হলো না। রবিন নেই এদিকে। এবার বৃত্তাকারে প্ল্যাটফর্মটাকে ঘিরে এগোল ও। দক্ষিণ দিকে পৌঁছেও মুসার কোনও দেখা পেল না। মুসা? গলা চড়িয়ে। ডাকল কিশোর। মুসা নিশ্চয়ই আশেপাশেই আছে। জবাব দিল না মুসা। বারবার ডাকল কিশোর, কোনও সাড়া নেই।