ইন্টারকমের আর দরকার পড়ল না, দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই খপ করে ধরল কিশোর।
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে উঠছে ওরা, চারপাশ থেকে টেলিভিশন, বাচ্চার কান্না আর মহিলাদের ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেল। চারতলার ল্যান্ডিঙে বাতি নষ্ট, ফলে অন্ধকার। যে-অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া হবে সেটার দরজায় ঝুলছে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ, ওটার ভিতর আগের ভাড়াটের কাছে আসা চিঠিপত্র।
ফোর-এর ভাড়াটে জেগে আছে, বলল কিশোর। অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর থেকে এতো জোরে ডেকসেট বাজার আওয়াজ আসছে যে গলা। চড়িয়ে কথা বলতে হচ্ছে ওকে।
কলিং বেল খুঁজে না পেয়ে দরজায় জোরে জোরে থাবড়া দিল কিশোর। বেশ কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর জিজ্ঞেস করল, ইয়াহ? কী চাই?
রবিনের দিকে এক পলক তাকাল কিশোর, তারপর চেঁচাল, বিগ ব্রাদার পেস্ট কন্ট্রোল। মিস্টার মিলহিজার আমাদের ডেকেছেন।
পেস্ট কন্ট্রোল? মোটা গলাটা প্রায় খেঁকিয়ে উঠল। এতো রাতে কী?
পোকামাকড় সহজে বিশ্রাম নেয় না, জবাব দিল কিশোর। সে কারণে আমরাও বিশ্রাম নিই না।
আমি ডাকিনি, ঘোঁৎ করে উঠল পুরুষ কণ্ঠ।
এটা কি ফোর-এ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এবার মহা বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল ভাড়াটে। বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে লোকটার। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ময়লা প্যান্ট আর কোঁচকানো গেঞ্জি পরে আছে।
কিশোর-রবিনকে পালা করে দেখল সে। কে তোমাদের ডেকেছে বললে যেন?
রবিন পকেট থেকে নোট বুক বের করে একটা খালি পাতায় চোখ বুলাল। মিস্টার নিক মিলহিজার।
ওই নামে এখানে কেউ নেই।
আমরা বোধহয় অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ভুল লিখেছি, বলল কিশোর। বোধহর উল্টোদিকের কোনও অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন উনি। চিনবেন ওঁকে আপনি। বয়সে যুবক। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা।
চিনি বলেই তো মনে হচ্ছে, বলল কোঁচকানো গেঞ্জি। কিন্তু যতোদূর জানি আজ বিকেলেই সে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। নানারকম আওয়াজ পাচ্ছিলাম, বেরিয়ে দেখি বাক্সপ্যাটরা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে।
তার নাম কি নিক মিলহিজার?
আমাকে দেখে কি এ-বাড়ির কেয়ারটেকার মনে হয় না কি! চোখ সরু করে কিশোরকে দেখল ময়লা প্যান্ট। জানি না তার নাম কী। জানতে চাইও না।
মিস্টার মিলহিজারের কি কোনও কুকুর আছে? জিজ্ঞেস করল। কিশোর। সহজে দমে যেতে রাজি নয় ও।
এই বাড়িতে কোনও কুকুর রাখার অনুমতি নেই।
কোনও রুমমেট ছিল?
আর কোনও কথা বলতে চাই না, বলল লোকটা।
গুড নাইট! বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত, বলল রবিন। ওর মুখের উপর দড়াম। করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
অত্যন্ত ভদ্রলোক, শুকনো গলায় বলল কিশোর। করিডরের উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার দিকে তাকাল ও। দরজাটা দাগে ভরা। ছোট একটা পেরেকে ফোর-বি লেখা কাগজ ঝুলছে।
ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। ওর পাশেই রবিন। দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে।
খোলা, বলল কিশোর।
আস্তে করে ঠেলা দিল রবিন, আরও কয়েক ইঞ্চি খুলে গেল দরজা। ভিতরে উঁকি দিল ওরা। সামনের ঘরে একটা আসবাবপত্রও নেই। কেউ থাকে বলে মনে হলো না।
দমকা বাতাসে হঠাৎ অনেকখানি খুলে গেল দরজা। রবিন আর কিশোর একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল ঘরের ভিতর। বেসবল ক্যাপ পরে আছে, এতো নিচু করে টেনে পরেছে যে, ক্যাপের বেড়ে থাকা সামনের অংশের কারণে তার চেহারা দেখা গেল না।
মিস্টার মিলহিজার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
যদি লোকটা নিক মিলহিজারও হয়ে থাকে, কোনও জবাব দিল না। সে। তার বদলে, ছোট একটা ক্যান তুলে ধরল সে, তারপর রবিন কিশোর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের চোখে-মুখে স্প্রে করল সে ওটা থেকে। হিসহিস আওয়াজ করে বাষ্পের মতো তরল ছিটে এসে লাগল ওদের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখে চলে গেল দুই গোয়েন্দার হাত। জিনিসটা যা-ই হোক, অসম্ভব জ্বলুনি শুরু হয়ে গেছে ওদের চোখে। চোখ ডলতে শুরু করল ওরা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না!
ধাক্কা দিয়ে কিশোর-রবিনকে সরিয়ে দেওয়া হলো, পায়ের আওয়াজ পেল ওরা। ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে লোকটা। সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেল, দ্রুত নেমে যাচ্ছে আক্রমণকারী।
চোখ মেলতে চেষ্টা করল কিশোর। কষ্ট হলো, তবে পারল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। চরম আতঙ্কের একটা স্রোত নেমে গেল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। ও কি অন্ধ হয়ে গেল?
কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি! প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল রবিন।
৮
আমিও না, বিড়বিড় করল কিশোর। আতঙ্ক সামলে নিতে চেষ্টা করে বলল, বোধহয় আমাদের চোখে মরিচের গ্যাস ছুঁড়ে চলে গেছে লোকটা। চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই চোখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা বন্ধ করেনি, বলল রবিন। ভেতরে পানি পাওয়া যাবে হয়তো।
হাতড়ে হাতড়ে দরজায় ধাক্কা খেয়ে ভিতরে ঢুকল ওরা। তুমি বামদিকের দেয়াল ধরে ধরে যাও, বলল কিশোর। আমি ডানদিকে দেয়াল ধরে যাচ্ছি। যে আগে কিচেন বা টয়লেট পাবে সে জানাবে।
ঠিক আছে। দেয়ালে রবিনের হাত ঘষা খাওয়ার আওয়াজ পেল কিশোর। নিজেও রওনা হয়ে গেল ও।
তিন মিনিট পর রবিনের ডাক শুনতে পেল কিশোর। বেসিন পেয়েছি। আমি কথা বলছি, তুমি আওয়াজ অনুসরণ করে এসো।
পানি পড়ার শব্দ পেল কিশোর। আস্তে আস্তে ওদিকে এগোল। কোনও আসবাবপত্র দেখিনি, কাজেই হোঁচট খাবে না কিছুতে, বলল রবিন। পানিতে কাজ হচ্ছে, অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি এখন।