গাড়িপথটা বেঁকে চলে গেছে একটা বিরাট পোর্টিকোর নীচে। ওখানে গাড়ি থামাল মুসা। নামল ওরা। সামনের কাঁচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে অফিসের ভিতর উপস্থিত শ্যারন, চীফ ইয়ান ফ্লেচার এবং আরও কয়েকজনকে।
কাঁচের দরজা ঠেলে অফিসে ঢুকল ওরা, চলে এলো রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারের সামনে। ওখানেই শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে শ্যারন। তিন গোয়েন্দা ঢোকার পর ফ্যাকাসে চেহারায় একটু রং ফিরে এলো ওর। ওদের দেখে হাসলেন ইয়ান ফ্লেচার। কি, রহস্যের গন্ধ পেয়ে হাজির হয়ে গেছ? জানলে কীভাবে যে এখান থেকে রকফেলারের কুকুরটা চুরি গেছে?
কিশোর জবাব দেওয়ার আগেই মরচে রঙা চুলওয়ালা এক প্রৌঢ় ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর চেহারায় বলে উঠলেন, কারা এরা?
ও কিশোর পাশা, ওদের পরিচয় জানালেন পুলিশ চিফ।
কিশোর বলল, আমরা গোয়েন্দা। যে-কোনও রহস্য সমাধানে আগ্রহী। ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে ডাকাতি-রাহাজানি-খুন, এমনকী ভৌতিক রহস্যের তদন্তেও পিছ-পা নই।
মনে হলো ওদের নাম আগে শোনেননি ভদ্রলোক, চোখ সরু করে। চীফের দিকে তাকালেন।
তোমরা সত্যিই তিন গোয়েন্দা? উত্তেজিত একটা স্বর জানতে চাইল। বক্তা এইমাত্র পিছনের দরজা দিয়ে অফিসে এসে ঢুকেছে। তরুণী মেয়েটা ওদের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবে। পরনের কাপড় কোঁচকানো, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ওয়াউ, পত্রিকায় তোমাদের কথা অনেক পড়েছি।
ও আয়োলা মর্টন, বলল শ্যারন। আয়োলা রাতে ডিউটি করে।
ব্যগ্র হয়ে এগিয়ে এসে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে একে একে হাত মেলাল তরুণী। স্মিত হেসে বলল, আমাকে অগোছাল দেখাচ্ছে বলে দুঃখিত। দুহাতে গাউনের ভাজ দূর করতে চেষ্টা করল। মিস্টার লেবউফ যখন ডাকলেন তখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম।
কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে, কড়া গলায় বললেন: মোটেল-মালিক গ্রেগ লেবউফ। শ্যারনকে আমি বরখাস্ত করছি।
কিন্তু আমি চুরির ব্যাপারে কিছুই জানি না, মিস্টার লেবউফ, ফ্যাকাসে মুখে প্রতিবাদ করল শ্যারন। আপনি এভাবে আমাকে অপমান। করবেন না।
হয়তো সত্যিই জানো না, বুকে হাত বাঁধলেন লেবউফ। তবে আমি আর আমার স্ত্রী এই মোটেলের মালিক। কাকে হায়ার করব আর কাকে ফায়ার করব সেটা আমাদের ইচ্ছে। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন তিনি। আমি গ্রেগ লেবউফ।
এবার মুখ খুললেন ইয়ান ফ্লেচার। আমার অফিসাররা পরীক্ষা করে দেখেছে, চোর এসেছিল কেনেলের পেছন দিকের দরজা খুলে। তালাটার ওপর কারিগরী ফলানো হয়েছে। আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে।
আমরা একটু ঘুরে দেখতে পারব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কেউ যদি কোলির চোরটাকে ধরতে পারে তা হলে ওরাই পারবে, জোর দিয়ে বলল আয়োলা। ওরা বিখ্যাত গোয়েন্দা।
মৃদু হেসে প্রশংসাটুকু গ্রহণ করল কিশোর, তারপর আবার তাকাল চীফ আর মিস্টার লেবউফের দিকে। ইয়ান ফ্লেচার হাতের ইশারায় ওদেরকে সঙ্গে আসতে বলে পা বাড়ালেন ভিতরের দিকে। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা। ওদের পিছু নিল বাকিরা।
একটা দরজা পার হয়েই কেনেল। এখানে খাঁচার ভিতর সাধারণ কাস্টোমারদের কুকুর রাখা হয়। চওড়া করিডরের দুপাশে সারি সারি দরজা। ওগুলো বড়লোক কাস্টমারদের শখের কুকুরদের বিলাশবহুল ঘর। ওগুলোর ভিতর সোফা, টেলিভিশন আর আরামদায়ক ফোমের খাটও আছে। ওগুলোর একটাতেই ছিল কোটিপতি হার্বার্ট রকফেলারের কোলি।
পরিচিত একটা ভউ-ভউ ডাক শুনতে পেল তিন গোয়েন্দা। আওয়াজ লক্ষ করে তাকাতেই দেখতে পেল রাফিয়ানকে। মাঝারি আকারের একটা খাঁচার ভিতর থেকে ঘনঘন লেজ নাড়ছে আর ছটফট। করছে রাফিয়ান। মুক্তি পেলেই ছুটে আসবে, সেজন্য অস্থির হয়ে আছে। রাফিয়ানের ডাক শুনে নানা আকারের খাঁচার ভিতর থেকে ডেকে উঠল। আরও কয়েকটা বিভিন্ন জাতের কুকুর। পকেট থেকে বিস্কুট বের করল মুসা, ছোট প্যাকেটটা খুলে রাফিয়ানকে দিল। আয়োলাও অন্যান্য খাঁচার কুকুরগুলোকে ডগ-বিস্কুট বিলি করছে।
করিডরের শেষ মাথায় থামলেন ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, স্টিলের তৈরি দরজাটা দেখালেন কিশোর, মুসা আর রবিনকে। এখান দিয়েই চোরটা ঢুকেছিল। এবার হাত নেড়ে বিদায় চাইলেন তিনি, মিস্টার লেবউফকে বললেন, চিন্তা করবেন না, তদন্ত করব আমরা। দেখা যাক চোরটাকে ধরতে পারি কি না। স্টিলের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। তিনি। একটু পরই তার গাড়ির আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেল।
দরজার ওপাশে চলে গেছে কিশোরও, পকেট থেকে ছোট্ট একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তালাটা পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। চাবি ঢোকানোর ফুটোর আশেপাশে আঁচড়ের দাগ ওর চোখ এড়াল না। এবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। রাস্তা দেখা যায় এখান থেকে। সহজেই এখানে আসতে পারবে চোর, ছোট দরজাটা তালাবদ্ধ থাকলে শুধু। তিনফুট উঁচ একটা দেয়াল টপকাতে হবে তাকে।
কী বুঝলে? দরজার কাছ থেকে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন গ্রেগ লেবউফ।
শ্যারনের অপমানটা এখনও ভুলতে পারেনি কিশোর, নিরাসক্ত গলায় বলল, চীফ ফ্লেচার যেমন বলেছেন, দেখে মনে হচ্ছে দরজাটা জোর করে খোলা হয়েছে। ভদ্রলোকের দিকে তাকাল ও। কোন ঘরে কোলিটা ছিল?
দরজা থেকে ডানদিকের প্রথম ঘরটা দেখালেন লেবউফ। দরজার তালা বন্ধ থাকে না। তাতে খাবার দিতে আর দেখাশোনা করতে সুবিধে। একবার বাইরের স্টিলের দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢোকার পর সহজেই ওটার কাছে যেতে পেরেছে চোর।