বিদায় নিয়ে ড্রাই-ডক থেকে বেরিয়ে আসার পর মুসা বলল, আমাদের কাজ কিছুই এগোচ্ছে না।
চলো, সৈকত ধরে কিছুক্ষণ ঘুরি, প্রস্তাব করল রবিন। রাফেলা বলেছে কালকে সে ধূসর গাড়িটা দেখেছে। কপাল ভাল হলে আমরাও হয়তো ওটার দেখা পেয়ে যাব।
হাঁটতে হাঁটতে নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, আপনমনে তদন্তের কথা বলতে শুরু করল, আমরা এক মহিলাকে চিনি, যিনি বিড়াল ভালবাসেন আর কুকুর ঘৃণা করেন। কিন্তু ডগ-হাউস বন্ধ করতে যা কিছু তিনি করেছেন, সবই আইনত সঠিক। আমাদের হাতে, এমন কোনও প্রমাণ নেই যে কোলিটা চুরি হওয়ার সঙ্গে তিনি কোনভাবে জড়িত। এদিকে হারল্ড মুর যেহেতু কাজে আসেনি, সে আমাদের গাড়িতে খুঁজে থাকতে পারে। হুকটা হয়তো সে-ই নিয়ে গেছে। এমনও হতে পারে সে কারিনা মুরের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা শুনেছে, তারপর ঠিক করেছে এ-ব্যাপারে নিজে সে কিছু করবে।
সবই আন্দাজ, বলল মুসা। আমাদের হাতে নিরেট প্রমাণ নেই।
হাঁটছে ওরা, এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে। কোথাও ধূসর গাড়িটা চোখে পড়ছে না। হাঁটতে হাঁটতে সেই পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসের কাছে। চলে এসেছে ওরা। একবার খুঁজে দেখা যায় ওখানে, বলল রবিন। হয়তো নতুন কিছু চোখে পড়ে যেতে পারে।
ফটকটা দেখছি বন্ধ, বিড়বিড় করল কিশোর, তারপর গলা চড়িয়ে বলল, জুলিয়ান বলেছিল না দরজা সবসময় খোলা থাকে?
ধীরে চলা একটা লাল পিকআপ ট্রাক পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ওরা, তারপর রাস্তা পার হয়ে ওয়্যারহাউসের দরজার কাছে চলে এলো। ঘুরেফিরে দেখল, দুদিকের দুটো দরজাই বন্ধ; তালা মারা।
এতোদিনে সম্পত্তি রক্ষা করার ব্যাপারে মালিকের হুঁশ হয়েছে, বলল মুসা।
কিশোর সামনের ফটকের এক পাশে ছোট্ট একটা কাগজ দেখাল। ওতে লেখা: এই ওয়্যারহাউস বিক্রি হইবে।
অবশ্য এমনও হতে পারে কেউ চায় না আমরা ভেতরে ঢুকতে পারি, বলল কিশোর।
আবার মস্ত বাড়িটার পিছনে চলে এলো ওরা। একটা জানালা নীল ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ক্যানভাসটা তুলল মুসা। ভিতরে। তাকিয়ে বলল, একটা ডেস্ক দেখতে পাচ্ছি। একটা চেয়ারও আছে। এটা সেই ঘর, যেটাতে পিট বুলটাকে ছেড়ে গিয়েছিল কুত্তাচোরা। অফিসটা পরিষ্কার করা হয়েছে।
পাশ থেকে উঁকি দিল কিশোর, মেঝেতে পড়ে থাকা হলদে কাগজটা ওর চোখে পড়ল। একটা জিনিস ওর নজরে পড়েছে। মুসাকে বলল, ক্যানভাসটা তুলে রাখো, আমি ওই কাগজটা চাই। জানালার কিনারা দিয়ে ঝুঁকে মেঝে থেকে পুরোনো খবরের কাগজটা সাবধানে তুলে আনল ও। ওটার ভাঁজ থেকে ছোট একটা ভিজিটিং কার্ড খসে পড়ল নীচে। ওটা তুলল কিশোর। বলল, গতকাল এটা চোখে পড়েনি। মুসা আর রবিনকে কার্ডটা দেখাল ও।
এক্সেলসিয়র ল্যাবোরেটরিজ, জোরে জোরে পড়ল রবিন। এখানে সব ধরনের পরীক্ষা করা হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই ঠিকানা দেওয়া আছে কার্ডে। রকি বিচের উত্তর প্রান্তে ল্যাবোরেটরিটা। আমাদের তদন্তের সঙ্গে এই ল্যাবোরেটরির কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে, নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর, হয়তো ওয়্যারহাউসে কাজ করত এমন কেউ ফেলে গেছে।
এমনও হতে পারে আসলে এটা ফেলে গেছে রাফিয়ানের অপহরণকারী। কার্ডটার অপর পিঠ দেখল ও, সঙ্গে সঙ্গে জ্ব সঁচকে উঠল। পেন্সিল দিয়ে একটা নাম লেখা আছে পিছনে। ম্যানর। পকেটে রেখে দিল কিশোর। আপনমনে বলল, এই ম্যানরটা কে হতে পারে?
আল্লাহ্ জানেন, বিড়বিড় করল মুসা। রবিন কাঁধ ঝাঁকাল।
ওয়্যারহাউসের মালিক কে সেটা আগে জানতে হবে আমাদের, বলল কিশোর। চলো, সরকারী কর অফিসে যেতে হবে।
রেস্তোরাঁর সামনে ফিরে এলো ওরা, ফোক্সওয়াগেন চেপে রওনা হলো মূল শহরের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছে মুসা, চলেছে টাউন স্কয়ারে। দুপুরের এই সময়ে ওখানে গাড়ি পার্ক করা বিরাট ঝামেলার কাজ। তবে মুসা পারল। একটা দামি স্পোর্টস্ কার খালি জায়গাটায় ঢোকার আগেই তোবড়ানো ফোক্সওয়াগন ঢুকিয়ে ফেলে বন্ধুদের দিকে চেয়ে বিজয়ীর হাসি হাসল মুসা।
চলো, গাড়ির দরজায় তালা মারার পর বলল মুসা, দেরি করতে চাই না। আমার আবার খিদে লেগে গেছে।
আশ্চর্যজনক হলেও রাস্তায় গাড়ির ভিড় তেমন একটা নেই। যাত্রীর দিকের দরজা খুলে নেমে পড়েছে রবিন, এবার কিশোর নামল। রবিন আর মুসা ফুটপাথে উঠে গেছে। একটা ফ্যাকাসে লাল পিকআপ ট্রাক বাঁক ঘুরতে দেখল কিশোর। ফোক্সওয়াগেনের দরজাটা বন্ধ করতে করতে শুনতে পেল এঞ্জিনের গর্জন। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ছুটে আসছে ট্রাকটা।
মুখ তুলে ও দেখল, রাস্তার মাঝখান থেকে সরাসরি ফোক্সওয়াগেনকে লক্ষ্য করেই তেড়ে আসছে ট্রাক। করে কী! চিৎকার করল মুসা। কিশোর, সাবধান!
ফোক্সওয়াগেনের সামনে দুফুট ব্যবধানে আরেকটা গাড়ি রাখা আছে, সেই ফাঁকটার দিকে দ্রুত এগোল কিশোর। পা বাড়িয়েই টের পেল, বড় বেশি দেরি করে ফেলেছে। সোজা সামনের গাড়ির নাকে দড়াম করে গুঁতো মারল ট্রাক। প্রচণ্ড ধাক্কার কারণে গাড়িটার হ্যান্ডব্রেক ওটাকে জায়গায় রাখতে পারল না। পিছলে গেল, চাকাগুলো। হড়কে পিছাতে শুরু করল গাড়িটা। মুসার ফোক্সওয়াগেন আর ওটার মাঝখানের ফাঁক নিমেষে কমে আসছে। রবিন আর মুসা স্পষ্ট বুঝতে পারল, দ্রুত সরতে না পারলে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে কিশোরের পা!;
৫
ঝট করে ফোক্সওয়াগেনের বোঁচা নাকের উপর উঠে পড়ল কিশোর। আরেকটু হলেই পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, ওয়াইপার দুটো ধরে তাল সামলাল। ঠিক তখনই সামনের গাড়িটার পিছনের দিক ফোক্সওয়াগেনের সামনের বাম্পারে ধাক্কা মারল। বাড়ি খেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল গাড়ি দুটো। লাফ দিয়ে ফোক্সওয়াগেন থেকে পাশের ফুটপাথে নামল। কিশোর। পিকআপ ট্রাক ততোক্ষণে পিছিয়ে গেছে, স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসা লোকটার মুখ এক পলকের জন্য দেখতে পেল তিন গোয়েন্দা। একটা রাবারের মুখোশ পরে আছে সে। গর্জন তুলে ছুটতে শুরু করল ট্রাক, সামনের বাঁকটা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।