আবার লম্বা লোকটার দিকে ফিরে তাকিয়ে কি যেন বলল গাজুল।
দেয়ালের দিকে ফিরে তিনজন লোককে ডেকে কথা বলল লম্বা লোকটা। অদ্ভুত সেই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারল না তিন গোয়েন্দা। গাট্টাগোট্টা তিনজন লোক এগিয়ে এল। হাতে তিনটে কিম্ভুত যন্ত্র। প্রতিটি যন্ত্র থেকে একটা করে মোটা নল বেরিয়ে আছে। নলের মাথায় চোখা সুচের মত জিনিস। সেগুলো গোয়েন্দাদের দিকে বাড়িয়ে দিল ওরা।
কি-কি-কি করছেন আপনারা! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
ভয় নেই, ডান হাতটা বাড়াও তো, গাজুল বলল। একটুও ব্যথা পাবে না। সুচের মাথায় ব্যথানিরোধক লাগানো আছে। এক দিক দিয়ে তোমাদের লাল রক্ত বেরোতে থাকবে, আরেক দিক দিয়ে রূপালী রক্ত ঢুকবে। দেখবে, দুনিয়াটাই পাল্টে গেছে তখন। খুব আরাম পাবে। নাও, হাতটা বাড়াও। তাড়াতাড়ি করো। মনিব অপেক্ষা করছেন।
মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ওদের চোখেও আতঙ্ক।
কিশোর বলল, তারমানে…তারমানে আপনাদের দেহেও রূপালী রক্ত?
হেসে মাথা ঝাঁকাল গাজুল। হ্যাঁ। আমাদের দেহে আর যন্ত্রপাতিতে আরও কিছু পরিবর্তন আছে, যেগুলো তোমাদের নেই। আমাদের মগজটাও অন্য রকম, তোমাদের মত না।
কোনও ধরনের রোবট না তো? কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল রবিনের।
মাথা ঝাঁকাল গাজুল, তা বলতে পারো। রোবটমানব। তবে রোবট হয়ে অসুবিধে নেই। মানুষ হওয়ার চেয়ে রোবট হওয়া অনেক শান্তির। কথা অনেক হলো। নাও, দেখি, ডান হাতটা বাড়াও তো এখন। আধঘণ্টার মধ্যেই দুঃখ-কষ্ট, বাড়ির জন্যে মন কেমন করা-কোন কিছুই থাকবে না আর তোমাদের।
.
২২.
কিশোরের হাতটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল একজন রোবটমানব।
চিৎকার করে উঠল কিশোর, না না!
ততক্ষণে রবিনের হাত চেপে ধরেছে একটা রোবট।
কিন্তু মুসাকে ধরতে যেতেই আচমকা ঘুরে দৌড় মারল সে। চিৎকার করে বলতে লাগল, কিশোর, রবিন, পালাও?
রূপালী টেবিলগুলোর ফাঁক-ফোকর দিয়ে ছুটতে থাকল ওরা। প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না কর্মরত রোবটরা। তারপর গাজুলের চিৎকারে তাড়া করে এল কয়েকজন।
ফিরে তাকাল কিশোর। গাজুল-মাজুল সহ আরও সাত-আটটা রোবট ওদের পিছু নিয়েছে।
প্রাণপণে ছুটতে লাগল তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে এল আরেকটা আয়না বসানো চকচকে হলরূমে। এত উজ্জ্বল, এত তীব্র আলো, চোখ মেলে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছি? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
জানি না! জবাব দিল কিশোর। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় যাচ্ছি কি করে বলব?
অন্ধের মত হোঁচট খেয়ে পড়ল সামনের দিকে। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।
সাড়াশির মত কঠিন আঙুল চেপে ধরল ওকে পেছন থেকে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে চিৎকার-চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি শুরু করল সে।
কিন্তু ধরা পড়ে গেছে। রবিন আর মুসাও ছাড়া পাওয়ার জন্যে চিৎকার করছে। হাত-পা ছুঁড়ছে। লাভ নেই। রোবটমানবেরা ওদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
কাছে এসে দাঁড়াল গাজুল-মাজুল।
গম্ভীর কণ্ঠে গাজুল বলল, অকারণ চেষ্টা, গোলামেরা। এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে আর পারবে না তোমরা কোনমতেই।
বাড়ি যাওয়া আর হবে না তোমাদের কোনদিন, হাসতে হাসতে বলল মাজুল। আর যদি হয়ও, লাল রক্ত নিয়ে যেতে পারবে না। রূপালী রক্ত নিয়ে যেতে হবে। তা-ও কোনও অপারেশনে, যদি মনিব মনে করেন তোমাদেরকে পাঠানো দরকার।
দরজার দিকে ফিরে তাকাল গাজুল। যন্ত্রহাতে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই তিনজন রক্তবদণকারী টেকনিশিয়ান। হাত নেড়ে তাদেরকে ডেকে বলল গাজুল, এসো। বদলে দাও।
তিন গোয়েন্দাকে যারা ধরেছে তাদের উদ্দেশে বলল সে, শক্ত করে ধরে রাখো। ছাড়বে না।
দরজায় দাঁড়ানো একজন টেকনিশিয়ান বলল, এখানে না বদলে ক্লিনিং রূমেই নিয়ে এসো না। রক্ত বদলানোর পর তো ধোলাই করার জন্যে সেখানে নিতেই হবে।
কি যেন ভাবল গাজুল। তারপর বলল, ঠিক আছে, নিয়ে চলো।
আবার ক্লিনিং রূমে নিয়ে আসা হলো তিন গোয়েন্দাকে। রূপালী টেবিলে তোলা হলো। চিত করে শুইয়ে দিয়ে হাত-পা চেপে ধরা হলো।
যন্ত্রের সুইচ টিপে দিতে লাগল টেকনিশিয়ানরা। মৃদু গুঞ্জন তুলে চালু হয়ে গেল মেশিন। সবার চোখ এখন এদিকে। ক্যাটওয়াকে যারা কাজ করছিল, কাজ। থামিয়ে দিয়ে তারাও তাকিয়ে আছে।
আর…আর বোধহয় বাঁচতে পারলাম না, গুঙিয়ে উঠল মুসা। গাজুল ঠিকই বলেছে। আমরা শেষ।
ফুঁপিয়ে উঠল রবিন। কান্নার মত স্বর বেরোল গলা থেকে।
কিশোর তাকিয়ে আছে তার পাশে দাঁড়ানো রোবটমানবের হাতের যন্ত্রটার দিকে। সুচের মত জিনিসটা তার ডান হাতের ওপর নিয়ে এসেছে রোবট। হাতের শিরা খুজছে ফুটিয়ে দেয়ার জন্যে।
চামড়া স্পর্শ করল সুচ।
তীক্ষ একটা ব্যথা।
শিরার মধ্যে বিধে গেল সুচ।
শীতল আতঙ্ক যেন গ্রাস করল কিশোরকে। অবশ হয়ে এল হাত-পা। মাথার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি। মুক্তির আর কোন উপায় নেই। কিছুই করার নেই। আর। হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।
ঠিক এই সময় ক্যাটওয়াকের কাছ থেকে গমগম করে উঠল একটা ভারী কণ্ঠ, কোথায়? কই? কাদের নিয়ে আসা হয়েছে?
কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগল কিশোরের।
চোখ মেলল আবার।
ক্যাটওয়াকের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠের মালিককে দেখেই স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারল কেন চেনা চেনা লাগছিল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।