খাঁচার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল গাজুল আর মাজুল।
পৌঁছে গেছি আমরা, গাজুল জানাল।
এমন ভঙ্গিতে কিশোর, মুসা আর রবিন তিনজনেই মাথা আঁকাতে লাগল যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে।
কখন নামলাম? মুসার প্রশ্ন। কোন শব্দ তো শুনলাম না। ঝাঁকুনি তো লাগল না।
কতক্ষণ লাগল আসতে? রবিন অবাক। কখন রওনা হয়েছি, মনে করতে পারছি না।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিশোর। এ জিনিসটা দিয়ে সম্ভবত সময় মাপা যায়। কিন্তু কি ভাবে মাপতে হয়, ভুলে গেছি।
খপ করে কিশোরের হাত চেপে ধরল রবিন। চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, একটা বড় কাটা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা ছোট কাটা। কোনটা দিয়ে কি হয়, বলো তো?
হেই, বাজে বোকো না! ধমকে উঠল গাজুল। তোমাদের বকবকানি শোনার সময় আমাদের নেই। মনে করেছে তোমাদের চালাকি আমরা ধরতে পারিনি। খুব ভালমতই পেরেছি। আমরা জানি কতখানি বুদ্ধিমান তোমরা।
খাঁচার একটা শিক চেপে ধরল গাজুল। তালা খোলার শব্দ হলো। এক ধরনের গুঞ্জন। তারপর পিছলে সরে গেল কয়েকটা শিক লাগানো একটা ফ্রেম। খুলে গেল দরজা।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে গাজুল আর মাজুল।
আমি খুব উত্তেজিত বোধ করছি, মাজুল বলল।
আমিও করছি, গাজুল বলল। আর উত্তেজিত হবই না বা কেন। এত চমৎকার তিনটে গোলাম নিয়ে এসেছি মনিবের জন্যে। তিনি ভীষণ খুশি হবেন।
উত্তেজিত আমরাও হচ্ছি, কিশোর বলল। মনিব দেখব। কখনও তো দেখিনি। তা ভাই মনিব জিনিসটা কোন ধরনের জীব? শিং আছে? লেজ কয়টা?
রবিন বলল, তাই তো! মনিব দেখব। বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিতে লাগল, কি মজা! কি মজা! মুসার দিকে তাকাল। মুসা, তোমার আনন্দ লাগছে না?
না, ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। যদি কামড়ে দেয়?
চুপ! চুপ করো! গর্জে উঠল গাজুল। বেরোও। এসো আমাদের সঙ্গে। আমাদের প্লেন ল্যান্ড করেছে মনিবের গম্বুজের ভেতরে। বেরোতে বেশি দেরি করলে মনি ভীষণ রেগে যাবেন।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, গম্বুজের ভেতরে। বলেন কি! ঢুকল কি করে?
সে গেলেই দেখতে পাবে, গর্বের সঙ্গে জবাব দিল গাজুল। পরক্ষণে বদলে গেল মুখের ভাব। ধমক দিয়ে বলল, খবরদার, বেশি কথা বলবে না। তোমাদের মনে রাখা উচিত, তোমরা গোলাম। কোন প্রশ্ন করবে না। কৌতূহল দেখাবে না। কথা বলতে যখন বলা হবে শুধু তখনই বলবে। মনে থাকবে?
নাহ্, থাকবে না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিল কিশোর। কি জানি কি হয়ে গেছে আমাদের, কিছুই মনে থাকে না। যাকগে, মন নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। তা আমাদের কাজটা কি? কি কি গোলামি করতে হবে?
মনিবের ব্যক্তিগত গোলাম হিসেবে তোমাদের কাজ হবে তার ল্যাবরেটরিতে থাকা, সারাক্ষণ সহযোগিতা করা। যেহেতু তোমরা অতিবুদ্ধিমান গোলাম, তোমরা তাঁর সমস্ত অংক করে দেবে, গাজুল বলল। কঠিন কঠিন সব ক্যালকুলেশন। অবশ্য সবই কম্পিউটারে। তোমরা…
আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের। কম্পিউটার! অংক! এগুলো আবার কি জিনিস?
তাকে ধমক লাগাল রবিন, গাধা নাকি! অংক কি জিনিস বোঝো না? নম্বর, নম্বর। একগাদা নম্বর।
নম্বর না, সংখ্যার হিসেব, অধৈর্য ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল গাজুল।
কিন্তু নম্বরের হিসেব তো আমরা কিছুই জানি না, বোকার মত রবিন আর মুসার দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। কি ভাবে কি করব, বলো তো? শেষে আমাদেরকে তাড়িয়ে দেবেন মনিব…।
উঁহু, শিং দিয়ে গুতো মারবে, শুধরে দিল তাকে মুসা। গাজুল-মাজুল যে ভাবে মনিবের নামে ভয় পাচ্ছে, আমার মনে হয় তার শিংগুলো খুব চোখা আর বড় বড়…
এই থামবে তোমরা! চিৎকার করে বলল মাজুল। গাজুলের দিকে ফিরল। ঘটনাটা কি বলো তো ওদের? এমন করছে কেন?
ও কিছু না, গাজুল জবাব দিল, ভয় পেয়েছে। ওদের কথায় কান দিও না। আমরা জানি ওরা কতখানি বুদ্ধিমান। চলো চলো, মনিবের সঙ্গে দেখাটা সেরে ফেলি।
হ্যাঁ, চলো।
তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল গাজুল। কি হলো, হাঁ করে দেখছ কি? বেরোতে বললাম না? নাকি লেজারের শক দেয়া লাগবে।
নির্বোধের মত প্রশ্ন করল কিশোর, সেটা আবার কি জিনিস? শিঙের চেয়ে খারাপ?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মাজুল। নাহ, মনে হচ্ছে ধরে প্রথমে ক্লিনিং রূমে নিয়ে যেতে হবে এগুলোকে। লাল রক্তের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছি না আমি।
তবে কি নীল রক্তও আছে? বেফাস প্রশ্ন করে ফেলল যেন কিশোর।
নীল নেই, তবে রূপালী রক্ত আছে। তোমাদের লাল রক্তের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী, নষ্ট প্রায় হয়ই না, আর রাসায়নিক পদার্থ পরিবহনের ক্ষমতাও লাল রক্তের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সত্যিই যদি তোমরা জান না করে থাকো, তোমাদের বুদ্ধি কমে গিয়ে থাকে, লাল রক্ত সব ফেলে দিয়ে দেহে রূপালী রক্ত ভরলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। নাও, চলো এখন।
গোলকযান থেকে ওদেরকে বের করে লম্বা একটা রূপালী হলওয়েতে নিয়ে এল গাজুল-মাজুল। ঘরের সব কিছুই যেন ক্রোম আর আয়নায় তৈরি। গোলকনটার মতই এখানেও সব কিছু চকচকে, যেন রূপালী আগুনের আভায় জ্বলছে।
হাঁটার সময় পায়ের শব্দ জোরাল হয়ে কানে বাজে। দ্রুত হাঁটছে গাজুল আর মাজুল। ওদের সঙ্গে সমতা রাখার জন্যে রীতিমত দৌড়াতে হলো তিন গোয়েন্দাকে।
চকচকে একটা ডাবল ডোরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দাঁড়াতেই আপনাআপনি যেন পিছলে নিঃশব্দে খুলে গেল দরজার পাল্লা। গাজুল-মাজুলের পিছু পিছু রূপালী একটা বড় বাক্সের মধ্যে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা।