আমি লক্ষ করেছি, মিস্টার বেলসন বললেন, ছেলেমেয়েরা এখন আর ওদের সঙ্গে খেলতে চায় না, কথা বলতে চায় না, দূরে দূরে থাকে, সব সময় এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। স্কুলের পরিবেশের জন্যে মোটেও সেটা ভাল কিছু নয়, বুঝতেই পারছেন।
ঘরের সবগুলো চোখ এখন ওদের দিকে, দেখতে পাচ্ছে কিশোর। দুরুদুরু করছে বুকের মধ্যে। তার মনে হচ্ছে ঘটনাটা বাস্তবে ঘটছে না। যেন স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে ওরা। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটা যে এতখানি বিপজ্জনক কল্পনাই করতে পারেনি কোনদিন।
তারমানে আর সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে ওরা। আলাদা করে ফেলা হচ্ছে ওদেরকে। ভবিষ্যতে আরও কি ঘটতে পারে কল্পনা করে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল শিহরণ।
তারমানে কোন ধরনের ফ্রিকে পরিণত হয়েছি আমি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
আমার কোন বন্ধু থাকবে না। সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
টিচাররাও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, কারণ আমি ওদের ভুল ধরে দিই।
তাহলে কি ঘটবে আমার?
দুই সহকারীর দিকে তাকাল সে। মুসা আর রবিন-ওরাও আর তার সহকারী থাকতে চাইবে না। কারণ ওদের মগজও তার মত একই রকম বুদ্ধিমান হয়ে গেছে।
মাথা নিচু করে আছে মুসা।
নিজের নখ খুঁটছে রবিন।
দুজনেই ভয় পেয়েছে। প্রচণ্ড ভয়।
চুপ করে আছো কেন? মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিছু বলো তোমরা।
আচমকা বলে উঠল রবিন, কি বলব? এর কোন ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারব না।
একটা জিনিস হতে পারে… বলতে গেল মুসা।
খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর, না না, মুসা, বোলো না। আঙ্কেল জ্যাককে আমরা কথা দিয়েছি কারও কাছে ফাস করব না।
কিন্তু না বললে দেখছ না কি রকম বিপদে পড়ে যাচ্ছি? রবিন বলল। না বলে পারা যাবে না।
কি না বলে পারা যাবে না? ধমকের সুরে বললেন রবিনের মা। আমার ভাই কি করেছে? বলো, জলদি! না বললে আমিই ওকে জিজ্ঞেস করছি। ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি।
মগজ উন্নত করার ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে আমাদেরকে, বলে ফেলল রবিন।
রবিন, থামো! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কিন্তু যা বলার বলে ফেলেছে রবিন। আর গোপন রাখা যাবে না। সুতরাং বাকিটাও বলে ফেলল রবিন, আমাদেরকে এক বোতল মগজ উন্নত করার ওষুধ দিয়েছিল আঙ্কেল জ্যাকবুদ্ধি বাড়ানোর জন্যে। হঠাৎ করে কেন জানি বোকা হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। তার কাছে গিয়ে সব বুলোম। বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছে আঙ্কেল জ্যাক, আমাদের কাকুতি-মিনতি শুনে একটা বোতল দিয়ে দিয়েছিল, তিনজনে ভাগ করে খাওয়ার জন্যে। এবং তাতে কাজ হয়ে গেছে। ওষুধ আমাদের বুদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এত বোকাই বা হয়ে গিয়েছিলে কেন, হঠাৎ করে? মেরিচাচী প্রশ্ন করলেন। টিচারদের দিকে তাকালেন। বোকা যে হয়ে গিয়েছিল, সেটা আমিও লক্ষ করেছি।
মিস্টার আমান বললেন, আমিও।
তাহলেই তো বোঝা যাচ্ছে, মিস্টার ক্রেগ বললেন, একটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল ওদের।
একটা নয়, দুটো, দুই আঙুল তুললেন মিস্টার মিলফোর্ড। একবার অতিরিক্ত বোকা হয়ে যাওয়া, একবার অতিরিক্ত বুদ্ধিমান। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। চালাকটা কি করে হলে, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বোকা হলে কি করে?
মাথা নাড়ল কিশোর, জানি না!
চুপ হয়ে গেল সবাই।
ঘরে পিনপতন নীরবতা।
দীর্ঘক্ষণ পর জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নীরবতা ভাঙলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। কোন ধরনের জাদু-করা-ফরমুলা এ রকম বুদ্ধিমান বানিয়েছে তোমাদেরকে আমি জানি না, তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি। তবে একটা কথা জানি। এ স্কুল তোমাদেরকে ছাড়তে হবে। আর তোমাদেরকে এখানে রাখা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।
১৬.
আরও কিছুদিন পর।
কিশোরদের লিভিং রুমে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। টিভি দেখছে।
…এই তিনটে ছেলে স্কুল বোর্ডের সঙ্গে আইনী লড়াই লড়ছে এখন, রিপোর্টার বলছে। প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার জন্যে ওদের কি আর স্কুলে পড়ার দরকার আছে? স্কুল বলছে, নেই। ওদের অভিভাবকেরা বলছে, আছে। সুতরাং লড়াইটা চলছেই…
পাশের ঘরে ফোনে কথা বলছেন মেরিচাচী। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে। না, আমাদের উকিল বলছে, জিতটা আমাদেরই হবে।…না না…নিশ্চয় নিশ্চয়…অন্য স্কুলের খোঁজেও রয়েছি আমরা। একটা প্রাইভেট স্কুলের সঙ্গে কথাও বলেছি। নিতে রাজি হয়েছে ওরা।…কি বললেন?…ও, আঙ্কেল জ্যাক। তিনি তো নেই এখন এখানে। সুইডেন চলে গেছেন একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তার স্ত্রীও গেছেন সঙ্গে।…নাহ, কোনভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সামনের দরজার বেল বাজল।
খুলতে যাওয়ার জন্যে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েও বসে পড়ল কিশোর।
নিশ্চয় আরেকজন সাংবাদিক। একই প্রশ্ন করতে থাকবে। গত কয়েক দিনে কম করে হলেও ডজনখানেক সাক্ষাৎকার দিয়েছে ওরা।
আগে ভাবত রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেয়াটা মজার ব্যাপার। কিন্তু এখন আর মজা নেই। লোকে যখন ওদেরকে ফ্রীক ভাবতে আরম্ভ করেছে। স্কুল থেকেও যখন বাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে, স্কুলে যেতে দেয়া হচ্ছে না ওদেরকে। তা ছাড়া.কে দেখবে এখন ওদের অনুষ্ঠান? কেউ তো ওদের পছন্দ করে না।
ওই ওষুধ আমাদের জীবনটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে, ভেবে মনটা তেতো হয়ে গেল কিশোরের।
সোফা থেকে উঠে এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। টেলিফোনে মেরিচাচী কি বলছেন ভাল করে শোনার জন্যে। এখন আর রবিনের আম্মার সঙ্গে নয়, একটা টিভি কোম্পানিকে ধমকাচ্ছেন তিনি, না, কোনমতেই যাবে না। ওই মগজ উন্নত করার ওষুধে কোন আগ্রহ নেই আমাদের।…বুঝলাম আপনাদের কোম্পানি খুব ভাল ফলের রস বানায়, কিন্তু আমার ছেলে আপনাদের বিজ্ঞাপন করতে যাবে না। সরি।