কি করেছ তোমরা? মিসেস মিলফোর্ড জিজ্ঞেস করলেন।
কই, কিছু তো করিনি, জবাব দিল কিশোর।
কিছু করিনি আমরা। রবিন বলল।
এসো আমাদের সঙ্গে। প্রিন্সপ্যাল মিসেস অ্যান্ডারসনের ঘরে যেতে বলা হয়েছে আমাদের।
মিসেস অ্যান্ডারসন? ভুরু কুঁচকাল মুসা। তার ওখানে যাব কেন? কোন অপরাধ তো করিনি আমরা। হচ্ছেটা কি?
ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হলো। দশ সেকেন্ড পর পিন্সপ্যালের অফিসের সামনের ঘরে ঢুকল ওরা। সামনের ঘরটা খালি। চারটে প্রায় বাজে। কর্মচারীদের সবার ছুটি হয়ে গেছে। বাড়ি চলে গেছে সেক্রেটারিরা।
পেছনের ঘর, অর্থাৎ মিসেস অ্যান্ডারসনের অফিসের দরজার দিকে এগোল সবাই। ঢোকার আগেই দরজায় বেরিয়ে এলেন তিনি। স্বাগত জানালেন ওদের। ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিলের সামনে বসা দেখা গেল কিশোরের চাচা-চাচী আর মুসার বাবা-মাকে। টেবিলের একধারে বসা মিস্টার ক্রেগ।:আরও একজন লোক আছেন সেখানে, মিস্টার বেলসন। স্কুল। পরিচালকদের সভাপতি। সবাই গম্ভীর।
মিসেস অ্যান্ডারসন এমনিতে হাসিখুশি, আন্তরিক, সবার সঙ্গেই উষ্ণ ব্যবহার করেন। কিন্তু এখন তিনিও গম্ভীর। রবিনের বাবা-মাকেও বসতে অনুরোধ করলেন তিনি।
শীতল দৃষ্টিতে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মিস্টার বেলসন। ফ্যাকাসে চামড়া, চকচকে টাক, কঠোর চেহারা। ধূসর সুট আর সরু নীল টাই পরেছেন। যতবার দেখেছে তাকে গোয়েন্দারা, এই একই পোশাকে। এগুলো ছাড়া যেন আর কোন কাপড় নেই তার।
বাইরের ঘর আর অফিসের মাঝের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। ঘুরে গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন। মুখ তুললেন। আসার জন্যে ধন্যবাদ দিলেন সবাইকে। ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে কিশোর, অস্বস্তিতে ভুগছেন মিসেস অ্যান্ডারসন।
কি ভাবে কথাটা শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না, অবশেষে শুরু করলেন তিনি। অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা।
.
১৫.
সমস্যা! মিসেস মিলফোর্ড বললেন। কুটি করলেন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে।
গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে কোন রকম অঘটন ঘটিয়েছে নাকি ওরা? জানতে চাইলেন মেরিচাচী।
আবার নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন মিসেস অ্যান্ডারসুন। হাত দুটো টেবিলের ওপর ফেলে রেখে মুখ তুললেন। না, কোন ধরনের অঘটন ওরা ঘটায়নি। কোন অপরাধ কিংবা অন্যায়ও করেনি। সমস্যাটা অন্য রকম।
কিশোর, মুসা, রবিনের মুখের ওপর থেকে ঘুরে এল মিসেস অ্যান্ডারসনের দৃষ্টি। আবারও বলছি, কি ভাবে কথাটা শুরু করব আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু না। বললেও চলছে না।
সোয়েটারের আস্তিনে বেরিয়ে থাকা একটা সুতো টেনে ঘেঁড়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার ক্রেগ।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন মিস্টার বেলসন। নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারে।
স্কুলের সবাইকে ঘাবড়ে দিচ্ছে কিশোর, মুসা ও রবিন, অবশেষে কথাটা যেন ছুঁড়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। শুধু তাই না, টিচারদেরকেও ওরা ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
কিন্তু, আমরা… বলতে গেল কিশোর।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। তিন গোয়েন্দার অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বললেন, মহাবুদ্ধিমান হয়ে গেছে আপনাদের ছেলেগুলো। আগে কেন বুঝতে পারিনি সেটাও এক রহস্য। তবে গত হপ্তা দুয়েক ধরে যা ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই আমাদের।
মহাবুদ্ধিমান? চোয়াল ডললেন রাশেদ পাশা। চোখ তুলে তাকালেন তিন গোয়েন্দার দিকে। মহা না হোক, তবে ওরা যে আর দশটা সাধারণ ছেলের চেয়ে বুদ্ধিমান সেটা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি।
সেটা তো আমরাও জানতাম, মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে অদ্ভুত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে ওরা। কিছুদিন এতটাই বোকা হয়ে রইল, যে ক্লাস পরীক্ষার সমস্ত টেস্টে ফেল করতে থাকল। আচার-আচরণে বোকামির চূড়ান্ত। কিন্তু গত দিন পনেরো ধরে হয়েছে উল্টোটা বুদ্ধিমত্তার চূড়ান্ত।
কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মধ্যে খারাপটা কি দেখলেন, তা তো বুঝতে পারছি না, না বলে আর পারলেন না মুসার আম্মা মিসেস আমান।
তা ঠিক, মাথা ঝাঁকালেন মিসেস অ্যান্ডারসন। খারাপ কিছু নেই। প্রতিটি পরীক্ষায় একশোতে একশো নাম্বার পায় ওরা। ক্লাসের যত বই আছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া মুখস্থ। বইয়ের পর বই, বইয়ের পর বই পড়ে শেষ করে ফেলে ওরা, একটা অক্ষরও ভোলে না সেগুলোর। যে কোন বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিলেও, যত কঠিন সাবজেক্টই হোক, বিশ-তিরিশ পৃষ্ঠার রচনা লিখে ফেলে অনায়াসে।
এটা তো দারুণ খবর! হাসলেন মেরিচাচী। সাংঘাতিক। তারমানে গোয়েন্দাগিরির ভূত গেছে মাথা থেকে। আজকাল পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে।
ঠিকই বলেছেন, এটা দারুণ খবরই, মোলায়েম স্বরে মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। সাংঘাতিক। কিন্তু মোটেও ভাল অর্থে নয়। বুদ্ধি এত বেশি বেড়ে গেছে, ক্লাসে সারাক্ষণ টিচারদের ভুল শুধরে দিতে থাকে। পাঠ্যবইতে ভুল খুঁজে পায়। ওদের কাণ্ড-কারখানায় ওদেরকে রীতিমত ভয় পায় এখন সহপাঠীরা। তারা জানে, কোন প্রতিযোগিতাতেই আপনাদের ছেলেদের সঙ্গে পারবে না ওরা। ওদের ধারণা, অস্বাভাবিক…মানে, অলৌকিক কোন ব্যাপার ঘটছে কিশোর, মুসা আর রবিনকে ঘিরে।
না না, খারাপ কিছু ঘটাচ্ছে না ওরা, মেরিচাচীকে কথা বলার জন্যে মুখ খুলতে দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মিস্টার ক্রেগ। ঝুঁকে এসেছেন সামনের দিকে। খুবই ভাল ছেলে ওরা। আসলে, যা করছে তার ওপর ওদের কোন হাত নেই। অনেক বেশি জানে ওরা। অনেক, অনেক বেশি। এই বয়েসের ছেলেদের তুলনায় সীমাহীন জ্ঞান ওদের, অস্বাভাবিক জ্ঞান। যেটা সত্যিই বিপজ্জনক, বুঝতেই পারছেন। স্কুলের পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ওরা।