জোর করে মুখে হাসি ফোঁটাল কিশোর, কি করব, এত কাজ।
ভাগ্যিস তোমাকে খুঁজে পেয়েছিল লং হার্ট, নইলে ছেলেমেয়েগুলোর যে কি দুর্দশা হতো ভাবাই যায় না।
অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা স্যারসাপ্যারিলা স্টিক বের করে হেনরির দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
লোভে চকচক করে উঠল হেনরির চোখ। ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিল ক্যান্ডিটা।
হেসে উঠলেন মিস্টার রনসন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস্টার রনসন। কাঁধের ওপর হেনরিকে সোজা করে বসাল আবার কিশোর। ওর আর কি দোষ। কতদিন যে মিষ্টি কিনে দিতে পারি না ওকে।
নিজের ভাইও এতটা করে না, কিশোর। সত্যি তুমি…
কথা শেষ করতে দিল না তাঁকে কিশোর। সিসি এসেছে রেসে অংশ নিতে।
ও জিতলে টাকার সমস্যাটা তোমাদের কমবে, তাই না?
হ্যাঁ। সেজন্যেই আসা। রাস্তার শেষ মাথার দিকে তাকাল আবার কিশোর। ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রতিযোগীরা। সিসিকে দেখতে পেল। গলায় হাত বুলিয়ে আদর করছে গোস্টকে। হাত তুলে দেখাল কিশোর, হেনরি, ওই যে দেখো, সিসি।
হাততালি দিল হেনরি। বোনের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল।
হেসে সিসিও হাত নেড়ে জবাব দিল।
হার্ট প্রায়ই আমাকে বলত, কিশোরকে বললেন মিস্টার রনসন, জন্তু-জানোয়ারকে বশ করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে সিসির মধ্যে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এখানেই দাঁড়াই, কি বলো, হেনরি?
সরে জায়গা করে দিলেন মিস্টার রনসন। হ্যাঁ হ্যাঁ, দাঁড়াও। এসো, ঢুকে পড়ো।…তবে যতই ক্ষমতা থাক, ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে জেতা মুখের কথা নয়। সিসি পারবে না। একেবারেই ছেলেমানুষ সে, ঘোড়াটাও তেমন কিছু না। আমার কি মনে হয়, জানো? যদি পারেও, না জেতাই ভাল হবে সিসির জন্যে। জিততে না পারলে পাগলা কুত্তা হয়ে যাবে দুই ভাই।
.
০৫.
প্রতিযোগীদের ঘোড়াগুলোর সামনে টানটান করে একটা রশি ধরে রেখেছে দুটো ছেলে।
ঘোড়ায় চড়োয় চিৎকার করে উঠল গ্যারিবাল্ড। রেস পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর। শুধু ব্যাংকের মালিকই। নয়, শহরের ভালমন্দ দেখার ভারও তার…
ভালমন্দ! মনটা তেতো হয়ে গেল কিশোরের। ভালটা কখনোই চোখে পড়ে না গ্যারিবান্ডের, কেবল মন্দটাই দেখে-এই যেমন একটা অসহায় পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে। উঠে-পড়ে লেগেছে। গতকাল এসে হুমকি দিয়ে গেছে কিশোরকে। অথচ এখন গোল ভূঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে এমন হাসি হাসছে যেন ঈশ্বরের পাঠানো দেবদূত। গাল দুটোও কুৎসিত রকমের ফোলা লোকটার। ঘেন্না লাগে! থুতু ফেলতে গিয়েও আশেপাশে লোক থাকায় ফেলল না কিশোর।
রশির কাছে এসে দাঁড়াল ডজনখানেক ঘোড়া। লাগাম ধরে তৈরি হয়ে আছে সওয়ারিরা।
ওদের মধ্যে সিসিই একমাত্র মেয়ে। দূর থেকেও ওর রক্তিম গাল দেখে মনের উত্তেজনা আঁচ করতে পারল কিশোর।
উত্তেজনার চেয়ে শঙ্কা বেশি কিশোরের মনে। সিসির দুই পাশে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই-জন আর মার্ক। দুদিক থেকে চেপে এসে গোস্টকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে রশির কাছ থেকে। জুনের বাহুতে ধাক্কা মারল সিসি। হেসে উঠল জন। নিজের ঘোড়া দিয়ে চাপ দিতে লাগল গোস্টের পেটে।
ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ভয় পেয়ে গেল কিশোর। রেসে জেতার চেয়ে সিসিকে আহত করার দিকেই যেন ওদের খেয়াল বেশি। ওদের মাঝখানে বড়ই ক্ষুদ্র আর ভঙ্গুর লাগছে বেচারি সিসিকে।
হাত উঁচু করল গ্যারিবাল্ড। হাতে পিস্তল। আকাশের দিকে তাক করে গুলি করল একবার। হাত থেকে রশির দুই মাথা ছেড়ে দিল ছেলে দুটো।
রশিটা মাটিতে পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল অশ্বারোহীরা। লাগামে টান দিয়ে চাপড় মারল ঘোড়ার গলায়। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ঘোড়াগুলো। ধুলোর ঝড় উঠল ওগুলোর ছুটন্ত খুরের আঘাতে।
নাকেমুখে ধুলো ঢুকে যেতে কেশে উঠল কিশোর। চোখ বন্ধ করে ফেলল। কানের কাছে চিৎকার করছে উত্তেজিত দর্শকেরা: জোরে, জন! মার্ক, আরও জোরে! রেসে যেন কেবল ওই দুজনই প্রতিযোগিতা করছে।
লোকে ভয় পায় ওদের। মনে মনে অন্য কাউকে সমর্থন করলেও প্রকাশ্যে সেটা জানানোর সাহস নেই। সিসির মত দুর্বল একটা মেয়ের পক্ষ নিলে নিজের বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু পাবে না।
জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে হেনরি। পা ছুঁড়ছে। ওর খুদে পায়ের লাথি লাগছে কিশোরের বুকে। কাঁধের ওপর তাকে সোজা করে বসাল কিশোর। দর্শকদের ঠেলে এগিয়ে গেল ভালমত দেখার জন্যে।
প্রাণপণে ছুটছে সিসি। দুই পাশে মার্ক আর জন। শুরু থেকেই গোস্টের প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে ঘোড়া দুটো। গোস্টের গায়ে ধাক্কা লাগছে। আগে বাড়ার পথ পাচ্ছে না সিসি।
হঠাৎ, হাত বাড়িয়ে গোস্টের লাগাম ধরে হ্যাচকা টান মারল মার্ক।
এলোমেলো পা ফেলতে শুরু করল গোস্ট। চিৎকার করে জোরে লাগাম টেনে ধরল সিসি।
সিসি! ধরে রাখো! ছেড়ো না! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কিশোর। পেটের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরেছে তার। ঘোড়াটাকে নিয়ে এখন সিসি পড়ে গেলে, দুজনেই মরবে, অন্য ঘোড়াগুলোর পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে।
নিষ্ঠুর, কুৎসিত হাসি দেখতে পেল দুই ভাইয়ের মুখে।
সামলে নিয়েছে গোস্ট। তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে সিসি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। প্রায় সবগুলো ঘোড়াই এখন গোস্টকে পার হয়ে চলে গেছে। আগে বাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সিসি। ঘোড়ার কাধ ডলে, পেটে পায়ের গুঁতো মেরে জোরে ছোটার ইঙ্গিত করছে।