সিসির জেতার সামান্যতম সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আর কিছু বলল না কিশোর। শহরে গেলে সিসি নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। জেতার কল্পনাটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
শহরের কাছাকাছি হতে লোকের হট্টগোল আর ব্যান্ডের বাজনার শব্দ কানে এল। চৌরাস্তায় এসে মেইন রোডে উঠল ওরা। প্রধান সড়কটাও কাঁচা। রাস্তার ওপরে উঁচুতে আড়াআড়ি ভাবে ব্যানার টানানো হয়েছে। লোকে-লোকারণ্য। কাঠের তৈরি সারি সারি দোকান। দরজায় বড় করে লেখা নোটিশ ঝুলছে: ঘোড়দৌড়ের জন্যে দোকান বন্ধ।
রাস্তার পাশে টানানো সাইনবোর্ড পড়ে জানা গেল ঘোড়দৌড় হবে মেইন রোডে। বেলা ১টায়। ঘড়ি নেই কিশোরের হাতে। কোথায় হারিয়েছে, তা-ও মনে করতে পারল না; জন্মদিনে পাওয়া ক্যামেরাটার মত। জোর করে মন থেকে দূর করল রকি বীচের ভাবনা। ভাবলে ভীষণ কষ্ট হয়। সূর্য দেখে অনুমান করল একটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই।
দারুণ, তাই না? উত্তেজনায় গলা কাঁপছে সিসির। মনে হচ্ছে আশপাশের অঞ্চলের আর কেউ নেই ঘরে, সব ঝেঁটিয়ে চলে এসেছে রেস দেখতে।
পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে টাউন হলের দিকে তাকাল সে। বারান্দা আর সিঁড়িতে দাঁড়ানো কিছু লোক। হাসাহাসি করছে, কথা বলছে। পিপার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। দুহাতে মাথার ওপর তুলে রেখেছে একটা বোর্ড। তাতে লেখা: ঘোড়দৌড়ে আগ্রহীরা এখানে এসে নাম লেখান।
নামটা লিখিয়ে আসি, সিসি বলল।
সিসির হাত থেকে লাগামটা নিয়ে নিল কিশোর। তুমি যাও। আমি গোস্টকে নিয়ে এগোচ্ছি। এক কাধ থেকে অন্য কাঁধে সরাল হেনরিকে। সিসির পিছে পিছে চলল।
বারান্দায় দাঁড়ানো লোকটাকে বলল সিসি, আমি নাম লেখাতে চাই।
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল বারান্দার হট্টগোল। সবার চোখ সিসির দিকে। যেন আরেকটা মাথা গজিয়েছে ওর।
চওড়া কাঁধওয়ালা লম্বা এক যুবক এগিয়ে এল সামনে। মেয়েমানুষ। তুমি রেস খেলবে কি?
নিজের নাকের ডগা টিপে ঘাম মুছল সিসি। কোথায় লেখা আছে সে-কথা, জন ফ্রেঞ্চ?
গাঢ় লাল চুলে আঙুল চালাল যুবক। লেখা নেই, কিন্তু নিয়ম কানুন সব মুখস্থ আমাদের। মেয়েমানুষ নেয়া হবে না।
অ, তাই নাকি। জানো যে, আমি খেললে জিততে পারবে। ভয়ে নিতে চাইছ না।
চোখের পাতা সরু হয়ে গেল জনের। তোমাকে ভয় পাব কেন! ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে কেউ পারে না।
এগিয়ে গেল কিশোর। সে জানে, শহরের সবাই ফ্রেঞ্চদের ভয় পায়। এলাকার সবচেয়ে ধনী পরিবার। টাকা আর ক্ষমতার জোরে যে কাউকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারে এ শহর থেকে। এখানকার স্থানীয় নয় ওরা। সেই সতেরোশো সালে উত্তর আমেরিকা থেকে এসেছিল ওদের পূর্বপুরুষ। ওদের দেখতে পারে না কিশোর, বিশেষ করে দুই ভাই জন ফ্রেঞ্চ আর মার্ক ফ্রেঞ্চকে। কেউ যদি না-ই পারে, নিতে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
আরে নিয়ে নাও, বলে উঠল আরেকটা ভারী কণ্ঠ।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল সেদিকে। দুটো সোনালি রঙের ঘোড়ার লাগাম ধরে টাউন হলের দিকে এগিয়ে আসছে মার্ক ফ্রেঞ্চ। হাঁটার তালে তালে ঢেউ খেলছে ঘোড়াগুলোর শক্তিশালী। পেশিতে।
দাও ওকে একটা সুযোগ, সিসিকে দেখাল মার্ক। খেলুক না। বুঝুক কেমন মজা।
দমে গেল কিশোর! ঘোড়া দুটো দেখেই বুঝে গেছে, ওগুলোর সঙ্গে পারতে হলে অলৌকিক ক্ষমতা লাগবে সিসির।
খুশিতে চিৎকার করে উঠল সিসি। থ্যাংকস, মার্ক। যাও কথা দিলাম, তোমাকে বেশি পেছনে ফেলব না আমি।
সিসির আত্মবিশ্বাস অবাক করল কিশোরকে। ভাবল, বড় বেশি ছেলেমানুষ।
বারান্দায় দাঁড়ানো একজন লোক হাত নেড়ে ডাকল সিসিকে। বড় একটা চকবোর্ড দেখাল। রেসে অংশগ্রহণকারীদের নাম লেখা রয়েছে বোর্ডটায়।
নাও, নিচে তোমার নাম লিখে দাও, চক বাড়িয়ে দিল সে।
পরিষ্কার অক্ষরে দ্রুত নিজের নামটা লিখে দিল সিসি।
মার্ক আর জনকে পরস্পরের দিকে তাকাতে দেখল কিশোর। মুচকি হাসি ওদের ঠোঁটের কোণে। শঙ্কিত হলো সে। আল্লাহই জানে, কি ফন্দি করেছে ওরা!
চকের গুঁড়ো কাপড়ে মুছে কিশোরের হাত থেকে লাগামটা নিয়ে নিল সিসি।
কিছুটা সরে এসে কানে কানে সিসিকে বলল কিশোর, ওদের ব্যাপারে সাবধান। ভাবভঙ্গি আমার ভাল লাগছে না।
চোখের তারায় ছায়া পড়ল সিসির। ভঙ্গিই দেখায় ওরকম। ওদের আমি ভয় করি না।
রেসের আগে বেশি কিছু বলে সিসিকে ঘাবড়ে দিতে চাইল না কিশোর। লাগামটা ফিরিয়ে দিল। হেনরিকে বলল, চলো, এমন কোথাও গিয়ে দাঁড়াই, ভালমত যাতে দেখতে পাই।
চিৎকার করে উৎসাহ দিও আমাকে, সিসি বলল।
দেব।
হেনরিকে কাঁধে নিয়ে কোলাহল মুখর জনতাকে ঠেলে পথ করে এগোল কিপোর। কাঁধে কাধ লাগিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে দর্শকরা। রাস্তার শেষ মাথার দিকে তাকাল সে। প্রতিযোগীরা তৈরি হচ্ছে। মেইন রোড ধরে সোজা ছুটে যাবে শহরের শেষ মাথায়, সেখানে রাখা একটা পিপা ঘুরে আবার ফিরে যেতে হবে যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানে। রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানোই ভাল, দৌড়ের সবটাই তাহলে দেখা যাবে।
দর্শকদের মাঝে এক ভদ্রলোকের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। গুড ডে, মিস্টার রনসন।
ঘুরে দাঁড়ালেন মিস্টার রনসন। তিনিও বিদেশী। এখানকার জেনারেল স্টোরের মালিক। এখানকার বাকি দোকানদারের মত আজকের দিনে তিনিও দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন, কিন্তু গা থেকে সাদা অ্যাপ্রনটা খোলেননি। আরি, কিশোর। আজকাল তো। তোমাকে দেখাই যায় না।