কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। খামারটা বাঁচানোর কোন উপায়ই মাথায় ঢুকছে না। নেকড়ের কবল থেকে বাঁচিয়ে এনে বাড়িতে জায়গা দেয়ায় হার্টের কাছে কৃতজ্ঞ সে। মৃত্যুকালে তাকে কথা দিয়েছে, সিসি আর হেনরিকে দেখবে। কথা যদি না-ও দিত, তাহলেও অসহায় ছেলেমেয়ে দুটোকে বাড়িতে একলা ফেলে চলে যেতে পারত না সে। যাওয়াটাও মুখের কথা নয়। যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে বেরোতে হলে প্রচুর টাকা দরকার। তার কাছে আছে মোটে বিশ হাজার চিলিয়ান পেসো, আমেরিকান ডলারে এর মূল্যমান পঞ্চাশ ডলারেরও কম। বাড়ির আলমারিতে সামান্য যা ফেলে গিয়েছিলেন হার্ট, তার অবশিষ্ট। এত কম টাকা দিয়ে কোনমতেই বড় শহরে পৌঁছতে পারবে না তিনজনে। তারপর আরও ঝামেলা আছে। রকি বীচে ফিরতে হলে পাসপোর্ট দরকার। সে-সব জোগাড় করতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিভাবে এসেছে এখানে, বোঝাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সব কিছুর জন্যেই মোটা টাকা প্রয়োজন।
মিস্টার গ্যারিবাল্ডের কথা ভাবল। এখানকার ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। গতকাল এসেছিল দেখা করতে। বলা ভাল, ধমকাতে।
লোকটার কথা মনে হতেই ভয়, আর রাগ একসঙ্গে মাথাচাড়া দিল মনে। হুমকি দিয়ে গেছে, সময় মত কিস্তি শোধ করতে না পারলে বাড়িঘর সব দখল করে নেবে। ওই চামারটার কাছ থেকে জমিটা ইজারা নিয়েছিলেন হার্ট। বাড়িঘর হাতছাড়া হলে নিজের ব্যবস্থা নাহয় একটা করে নিতে পারবে কিশোর, কিন্তু পথে বসবে সিসি আর হেনরি। কি হবে ওদের?
মনকে শক্ত করল সে। এখন টাকা জোগাড়ের একটাই উপায়, ফসল ফলানো। খচ্চরের পিঠে আবার বাড়ি মারল, লাগাম দিয়ে। হাট, ব্যাটা, খচ্চরের বাচ্চা! তোর জন্যে সারাদিন খেতে পড়ে থাকব নাকি?
বাড়ি খেয়ে চিৎকার করে উঠল জানোয়ারটা। এক পা আগে বাড়াল।
হ্যাঁ, থামবি না, সাবধান করল কিশোর। লাঙলের হাতলে শক্ত হলো আঙুল। ফালের খোঁচায় কেটে দুদিকে উল্টে পড়তে শুরু করল আবার কালো মাটি।
দেহের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু পরোয়া করল না আর কিশোর।
ডাক শুনে ফিরে তাকাল সে। দৌড়ে আসতে দেখল সিসিকে। কাঁধে নাচছে কালো বেণী। পেছন পেছন আসছে হেনরি।
মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। দৌড়ানোর ভঙ্গিটা ভাল লাগল না তার। খারাপ কিছু ঘটল নাকি!
লাঙলের হাতল ছেড়ে দিয়ে ওদের দিকে দৌড় দিল সে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, সিসি? কি ব্যাপার?
দাঁড়িয়ে গেল সিসি। হাসল। না না, কিশোরভাই, ভয় পেয়ে না। খারাপ কিছু হয়নি।
দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। তাহলে ওরকম চিৎকার করছিলে কেন?
ঝিক করে উঠল সিসির সবুজ চোখের তারা। আমাদের শহরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না আজ তোমার, মনে নেই?
সরি, সিসি, আজ পারব না। অনেক কাজ পড়ে আছে, খেতের দিকে হাত তুলে দেখাল কিশোর।
কালো হয়ে গেল সিসির সবুজ চোখের তারা। উধাও হয়ে গেছে হাসি। মুখ নিচু করে বলল, কিন্তু তুমি আমাদের নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিলে!
দিয়েছিলাম। কিন্তু…
প্যান্ট খামচে ধরে টান দিল হেনরি। মুখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে। চোখে টলমল করছে পানি। সবুজ দৃষ্টিতে কাতর অনুনয়।
তুমিও শহরে যেতে চাও?
নীরবে মাথা ঝাঁকাল হেনরি। হার্ট দম্পতি মারা যাওয়ার পর থেকে কোন কথা বলে না সে। প্রচণ্ড শ পেয়েছে বোধহয়। কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
মাটিতে বসে পড়ল কিশোর। টোকা দিয়ে একটা লাল রঙের গুবরে পোকা ফেলল হেনরির পা থেকে। পরনের ওভারঅলটা অতিরিক্ত খাটো হয়ে গেছে ওর। সিসির দিকে তাকাল। বড় বড় ফুলওয়ালা নীল পোশাকটা মলিন, বিবর্ণ। ফসল ঘরে না ভোলা পর্যন্ত কাপড় কিনে দেয়ার উপায় নেই।
জানি, শহরে যাওয়ার বড় শখ তোমাদের, কিশোর বলল। কিন্তু জমি না চুষলে ফসল বোনা যাবে না। ফসল না হলে জায়গা-জমি বাড়ি-ঘর সব হারাতে হবে আমাদের।
কিন্তু, কিশোরভাই, পাশে বসে কিশোরের হাত খামচে ধরল সিসি। সবুজ চোখে উত্তেজনা। টাকার জন্যেই তো যেতে চাইছি আমি। ভাবছি, ঘোড়দৌড়ে আমিও অংশ নেব। প্রথম পুরস্কার এক লাখ পেসো আমিই পাব, দেখো। আমি জানি, আমি জিতব!
এক লাখ! প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর। টাকাটা পেলে ফসল ওঠা পর্যন্ত কোনমতে চালিয়ে নিতে পারবে সংসার।
সত্যি কি জিততে পারবে সিসি?
পারবে না। এত এত প্রতিযোগী রয়েছে। তাদের সঙ্গে সিসির জেতা, টাকা পাওয়া, সংসার চালানো…দূর! ছেলেমানুষী চিন্তা।
দেখো, সিসি, বোঝাতে গেল সে, আমি জানি, তুমি ঘোড়ায়। চড়ার ওস্তাদ। কিন্তু অন্য ওস্তাদেরাও আসবে। তাদের সঙ্গে পারবে না।
ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল সিসি। জ্বলন্ত চোখে তাকাল। আমি জিতব! আমি জিতব! আমি জিতব! তুমি যদি আমাকে নিয়ে যেতে না চাও, আমি একলাই যাব।
এতদিনে এই দৃষ্টির অর্থ জানা হয়ে গেছে কিশোরের। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সিসি, কোনভাবেই আর ঠেকাতে পারবে না তাকে। এ ধরনের গোয়ার্তুমি কিশোরের। নিজের মধ্যেও আছে। আরেকজনকে বুঝিয়ে লাভ নেই। উঠে দাঁড়াল সে। দাঁড়াও, হ্যাটটা নিয়ে আসি।
.
০৪.
হেনরিকে কাঁধে বসিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে চলল কিশোর। পাশে পাশে হাঁটছে সিসি। টানতে টানতে নিয়ে চলেছে তার প্রিয় ঘোড়াটাকে। ঘোড়াটা কালো। নাম গোস্ট। পিঠে চড়েই যেতে পারত সিসি, কিন্তু দৌড়ের আগে গোউকে ক্লান্ত করতে চায় না।