কোনমতেই থামানো যায়নি ঘোড়াগুলোকে। সোজা ধেয়ে গিয়েছিল খাদের দিকে। ডিগবাজি খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল পাড়ের ওপাশে।
অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে কিশোরকে। সাহায্য করার কোন সুযোগ ছিল না।
.
০৩.
দুর্ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে কিশোর। হাজার ভেবেও কোন কূলকিনারা পায়নি। কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করল ঘোড়াগুলো? বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল? নাকি বজের শব্দে ভয় পেয়েছিল?
সূত্র খুঁজে বেড়িয়েছে কিশোর ভাঙা গাড়িটায়, খাদের ওপরে, খাদের নিচে। কিছুতেই বুঝতে পারেনি, ঘোড়াগুলোর ওভাবে হঠাৎ খেপে যাওয়ার কারণ। রহস্যটা এখনও অমীমাংসিত।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো, কোন প্রাণীর ওপর হার্টকে এ ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারাতে আর দেখেনি সে। বরং উল্টোটাই দেখেছে। সব জানোয়ার তাঁর কথা শুনত। গৃহপালিত তো বটেই, বনের জানোয়ারও তার কথা অমান্য করত না। করত যে না, সেটা তো কিশোর নিজের চোখেই দেখেছে। জানোয়ারে কথা না শুনলে আজ সে এখানে থাকত না, কোনদিন ওদের খাবার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেত।
মনে পড়ল রকি বীচের সেই দিনটির কথা। ভুল তারিখে তার জন্মদিন করে ফেলেছিলেন মেরিচাচী। ভুলটা যে কি করে করলেন তিনি, সেটাও এক রহস্য। আর যারই হোক, কিশোরের জন্মদিনের তারিখ নিয়ে অন্তত মেরিচাচীর ভুল হওয়ার কথা ছিল না। রহস্যটা ভেদের সুযোগই পায়নি কিশোর।
জন্মদিনে নতুন ক্যামেরা উপহার পেয়েছিল সে। সেই ক্যামেরা নিয়ে লেকের পাড়ের বনে ইউ.এফ. ওর ছবি তুলতে গিয়েছিল। আকাশে বিচিত্র মেঘ দেখেছিল। দেখেছিল রঙিন ফানেল। তারপর অন্ধকার। অন্ধকার কেটে গেলে শুরু হলো দুঃস্বপ্ন…মস্ত এক কাঁচের পাইপে ভরে রাখা হয়েছে তাকে…পালাল সে ওটার ভেতর থেকে…বিশাল ল্যাবরেটরির মধ্যে দিয়ে ছুটল…বেরোতে পারল না, ধরে ফেলা হলো তাকে…আবার পালাল…আবার ধরা পড়া…আবার। পালানো…আবার ধরা…শেষে নেতা গোছের লোকটা মহাখাপ্পা হয়ে তার সহকারীদের বলল-ভয়ঙ্কর ছেলে; একে এখানে রাখা যাবে না। এমন কোথাও রেখে এসো, যেখানে মুক্তও থাকবে আবার বন্দিও থাকবে, আমাদের খপ্পর থেকে কোনমতেই বেরিয়ে যেতে পারবে না…লোকটার মুখে ডাক্তারদের মাস্ক ছিল, চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা চেনা চেনা-কোথায় শুনেছে ওই কণ্ঠ, স্বপ্নের মধ্যে মনে করতে পারেনি কিশোর…
তারপর আর কিছু মনে নেই। হুঁশ ফিরলে দেখল, একটা বনের মধ্যে পড়ে আছে সে। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। নানা রকম বুনো জানোয়ারের ডাক কানে আসতে লাগল। হঠাৎ দেখল, মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে লাল চোখ মেলে তাকে দেখছে একটা বিশাল নেকড়ে। হাঁ করা মুখ থেকে ঝুলছে টকটকে লাল জিভ। অসংখ্য ধারাল দাঁত যেন তাকে ছিঁড়ে খেতে প্রস্তুত।
এটাও কি আরেক দুঃস্বপ্ন? নিজের বাহুতে চিমটি কেটেছে কিশোর। ব্যথা পায়নি। না, স্বপ্ন নয়, ভয়ঙ্কর বাস্তব।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দৌড় দিতে গিয়ে লক্ষ করল, একটা নয়, একপাল নেকড়ে ঘিরে ফেলেছে তাকে। গাছে ওঠারও সময় পাবে না সে। ছুটে এসে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। নেকড়েরা।
তারমানে নিশ্চিত মৃত্যু। চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগল। কিশোর, ধারাল দাঁতগুলো কখন তার গায়ে বেঁধে!
বিঁধল না। কানে এল মানুষের ফিসফিসে চাপা কণ্ঠ। চোখ মেলে দেখল অবিশ্বাস্য দৃশ্য। একজন মানুষ। ইনডিয়ান। পরনে শুধু প্যান্ট। গায়ে কিছু নেই। লম্বা লম্বা চুল। কথা বলছেন নেকড়েগুলোর সঙ্গে। পোষা কুকুরের মত তার পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতে শুরু করেছে নেকড়েগুলো। এ যেন আরেক টারজান!
কিশোরকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে এলেন হার্ট। আরও চমক অপেক্ষা করছিল কিশোরের জন্যে। হতবাক হয়ে গেল, যখন জানতে পারল দক্ষিণ আমেরিকায় রয়েছে সে। অ্যান্ডিজের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ঘেরা একটা অতি দুর্গম শহর-কাচু-পিকচুতে।
বোকা হয়ে গিয়েছিল। এখানে এল কি করে সে? ইউ এফ ও তো নিয়ে যায় ভিনগ্রহে। পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়ার কথা নয়!
তাকে পাগল ভাববে মনে করে হার্টকে সত্যি কথাটা বলল। বলল না, দুনিয়ায় তার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। বানিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার একটা শহরের নাম বলে দিল।
সেই থেকেই এ বাড়িতে আছে কিশোর। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার গেছে সেই বনে, যেখানে নেকড়ের কবলে পড়ে মরতে বসেছিল। বহু খোঁজাখুঁজি করেছে, সূত্র খুঁজেছে। এক জায়গায় মাটিতে বসে যাওয়া ছয়টা ছোট ছোট বিচিত্র গর্ত ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। মনে হয়েছে, ভারী কিছুর পায়ের চাপে তৈরি হয়েছে গর্তগুলো…
জানোয়ার বশ করার ক্ষমতাটা হার্টের কাছ থেকে রপ্ত করেছে সিসি। হাতে ধরে তাকে শিখিয়েছেন হার্ট। চেষ্টা করলে হয়তো কিশোরও শিখে নিতে পারত। কিন্তু কে জানত এমন বিপদে পড়বে! না শিখে এখন আফসোস হচ্ছে। বিদ্যেটা জানা থাকলে পাজি, কর্মবিমুখ, বেয়াড়া খচ্চরটাকে কাজ করাতে অসুবিধে হত না এখন। এটাকে দিয়েই তো দিব্যি হাল টানাতেন লং হার্ট, কোনই সমস্যা হত না। জানোয়ারটা কথা শুনত তার…
বাস্তবে ফিরে এল আবার কিশোরের মন। চারপাশে ছড়ানো জমিটার দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল। সন্দেহ হচ্ছে, কোনদিনই হাল দিয়ে শেষ করতে পারবে না। ফসল বোনা তো দূরের কথা।