বাড়ির দিকে তাকাল কিশোর। বিশাল ওক গাছটার নিচের কবর ফলক দুটো এখান থেকেও দেখা যায়। রোদের মধ্যেও গায়ে। কাটা দিল তার। ইনডিয়ান দম্পতির মৃত্যুটা এখনও তার কাছে রহস্যময়।
নিজের অজান্তেই বুজে এল চোখের পাতা। সিসি আর হেনরিকে দেখতে পেল কল্পনায়। আবার চোখ মেলল। বিশাল বাড়িটাতে ওই দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে একা থাকতে হয় তাকে।
কানে বাজতে লাগল লং জন হার্টের যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠ: ছেলেমেয়ে দুটোকে তুমি দেখো, কিশোর! তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম ওদের!
যে বিকেলে মারা গেছেন হার্ট আর তার স্ত্রী কোরিনা, সেই বিকেলটা এখনও জ্বলজ্বলে তার স্মৃতিতে। ধূসর মেঘ জমেছিল আকাশে। ঠাণ্ডা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ। কাঠের দোতলা বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। তাকিয়ে দেখছিল, স্ত্রীকে ওয়্যাগনে উঠতে সাহায্য করছেন হার্ট। দূরের এক আত্মীয় বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে যাবেন।
ওয়্যাগনে বসে মাথার টুপিটার ফিতে বেঁধেছেন কোরিনা। ফিরে তাকিয়েছেন কিশোরের দিকে, বাবা, ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখো। পারবে না?
মাথা ঝাঁকিয়েছে কিশোর।
সিসি আর হেনরিকে বলেছেন কোরিনা, তোমাদের কিশোর ভাইয়ের কথা শুনবে তোমরা। কি, বুঝতে পেরেছ? নইলে কিন্তু আমরা ফিরে আসার পর কোন উপহার পাবে না।
মুখ গোমড়া করে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়েছে সিসি। হেনরি কোন কথা বলেনি। কুটি করে আপনমনে ছেঁড়া একটা কাপড়ের তৈরি খেলনা ক্রমাগত ঘুরিয়েছে ছোট ছোট আঙুলে। গাল ফুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে অনুরোধ করেছে, আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব, কোরিআন্টি।
হেনরি, তোমাকে সিসি আর কিশোরের সঙ্গে এখানেই থাকতে হবে, কঠোর হয়েছেন কোরিনা। লক্ষ্মী ছেলের মত থাকো। আসার সময় তোমাদের জন্যে অনেক কিছু নিয়ে আসব আমরা।
অনেক কিছু তো চাই না আমরা, হিসিয়ে উঠেছে সিসি। আমরা তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই।
সিসি আর হেনরির কাঁধে হাত রেখেছে কিশোর। থাক, যাবার দরকার নেই। নিতে যখন চাইছেন না কোরিআন্টি, নিশ্চয় কোন কারণ আছে। এখানেই থাকো তোমরা, আমার সঙ্গে। আমাকে খারাপ লাগে?
জোরে জোরে মাথা নেড়েছে হেনরি আর সিসি।
না না, তোমাকে খুব ভাল লাগে আমাদের, কিশোরভাই, সিসি বলেছে। তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই যদি আন্টিদের সঙ্গে যেতে পারতাম, আরও ভাল লাগত।
সকাল থেকেই কোরিনার পিছে লেগে থেকেছে দুই ভাই বোন। কতভাবে অনুরোধ করেছে সঙ্গে নেয়ার জন্যে। কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু আন্টি অটল। কোনমতেই রাজি হননি। কিশোর বুঝেছে, বাধা না থাকলে সিসি আর হেনরিকে সঙ্গে না নিয়ে যেতেন না। ওদের বাবা-মা নেই। কোথায় আছে-মারা গেছেন না। বেঁচে আছেন, সেটাও আরেক রহস্য। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেও কোন জবাব বের করতে পারেনি কিশোর। হার্টদের সঙ্গে সিসি বা হেনরির রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাবা-মায়ের অবর্তমানে বাবা মার মতই স্নেহ দিয়ে দুজনকে বড় করতে চেয়েছেন ওই ইনডিয়ান দম্পতি। সুতরাং নেননি যখন, বোঝাই গেছে-সঙ্গে নেয়ার উপায় ছিল না।
সিসির বয়েস তেরো। হেনরির ছয়। কিশোরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এমন করে গিয়ে সিঁড়িতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল দুজনে, মায়াই লাগছিল কিশোরের। দুজনেরই কালো চুল। দুজনেরই কান্নাভেজা সবুজ চোখের তারায় জ্বলছিল রাগের আগুন।
নিশ্চিন্তে চলে যান আপনারা, হেসে বলেছে কিশোর। সিসি আর হেনরি ঠিকমতই ঘরের কাজ করবে, সকাল সকাল ঘুমাতে যাবে…
তার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেঙচি কেটেছে সিসি, হেসেছে কিশোর।
ঘোড়ায় টানা ওয়্যাগনে সামনের বেঞ্চসীটে উঠে বসেছিলেন হার্ট। চাকার ব্রেক ছেড়ে কিশোরের দিকে ফিরে বলেছেন, শনিবার নাগাদ ফিরব।
ঘোড়া চালানোর জন্যে চাবুক মারার দরকার পড়ত না হার্টের। লাগাম তুলে সামান্য টান দিতেই কোন রকম প্রতিবাদ না করে চলতে শুরু করেছে চারটে ঘোড়া।
ওঁদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়েছে কিশোর। সিসি আর হেনরিকে নাড়তে বলেছে।
না, নাড়ব না! রাগ করে হাত দুটো কোলের কাছে গুটিয়ে নিয়েছে সিসি।
নাড়ব না! বোনের দেখাদেখি হেনরিও একই ভাবে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
আমি ওদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, সিসি বলেছে, নিল! রাগ করে পা ঠুকল সিঁড়িতে।
নিল না! দেখাদেখি হেনরিও পা ঠুকেছে।
হঠাৎ, আকাশের বুক চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুৎ-শিখা। শোনা গেল বজের চাপা গুড়গুড় শব্দ। কিশোরের মনে হচ্ছিল পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। তীব্র গতিতে পিঠে ঝাঁপটা দিচ্ছিল বরফের মত শীতল ঝোড়ো হাওয়া।
ঘোড়াগুলোর আর্তচিৎকার কানে আসতে আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে কিশোর। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে চারটে ঘোড়াই। খুর দিয়ে বাতাস খামচে ধরতে চাইছিল যেন। পরক্ষণেই মাটিতে পা নামিয়ে পাগলের মত লাফ মেরেছে সামনের দিকে।
মরিয়া হয়ে লাগাম টেনে ওগুলোকে সামলানোর চেষ্টা করেছেন হার্ট। চিৎকার করে ডেকে ডেকে শান্ত করতে চেয়েছেন।
লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে ছুটে গেছে আতঙ্কিত কিশোর।
চিৎকার করে ঘোড়াগুলোকে থামতে বলেছে। কিন্তু বিফল হয়ে বাতাসে ভেসে গেছে তার ডাক। হার্টই যেখানে থামাতে পারেননি, সে থামাবে কি?
টানতে টানতে গভীর খাদের দিকে ওয়্যাগনটাকে নিয়ে গেছে। ঘোড়াগুলো পড়লে নিজেরাও যে মরবে সে-খেয়াল ছিল না। টান সামলাতে না পেরে, ঝাঁকুনি লেগে চিত হয়ে পেছনে উল্টে পড়ে গিয়েছিলেন হার্ট। ওয়্যাগনের ধার আঁকড়ে ধরেছিলেন কোরিনা। হ্যাচকা টানে মাথার টুপিটা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বাতাস, ফিতে বাঁধা থাকায় পারেনি, ফাঁসের মত গলায় টান দিচ্ছিল সেই ফিতে। বাতাসে উড়ছিল লম্বা চুল।