*
উপত্যকার একটা ভোলা জায়গায় বেরিয়ে এল কিশোর।
মেঘ সরে গেছে চাঁদের মুখ থেকে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় চকচক করতে দেখল অদ্ভুত একটা গোল জিনিসের পিঠ। আলো আসছে ওটার নিচ থেকে।
অবাক কাণ্ড! এখানেও ইউ এফ ও?
একবার ইউ এফ ও দেখতে গিয়েই তো আজকের এই দুর্দশা। দ্বিতীয়বার আর কোন বিপদে ঢুকতে চায় না সে। পা টিপে টিপে এগোল।
যতটা সম্ভব কাছে পৌঁছে গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। গোল জিনিসটার ছয়টা পা।
ছয় পা!
তাই তো! বনের মধ্যে যে ছয়টা গর্ত দেখেছিল, কিসের কারণে হয়েছে সেগুলো, জবাবটা পেয়ে গেল এখন। আরও একটা প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল, ইউ এফ ও-তে করেই তাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল এখানে। আবার এসেছে কেন ওরা? তাকে তুলে নিয়ে যেতে?
পেটের কাছে একটা হ্যাচ খুলে সিঁড়ি নামানো হয়েছে। সেটা দিয়ে নেমে এসেছে কয়েকজন মানুষের মত প্রাণী। পোশাক আশাকে পৃথিবীর মানুষের মতই লাগছে। শুধু তাই না, চেনা চেনাও লাগছে।
গাছপালার আড়ালে আড়ালে আরও কাছে এগোনোর চেষ্টা করল সে। খুব সাবধান থাকল। যাতে কোনমতেই লোকগুলোর চোখে পড়ে না যায়।
কাছে এসে চিনতে পেরে হাঁ হয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না।
মুসা, রবিন, জিনা!
আর, আর রিটা গোল্ডবার্গ!
নাহ, এ সত্যি হতে পারে না!
চোখ ডলল সে। নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল ব্যথা লাগে কিনা।
লাগে! তারমানে যা দেখছে, বাস্তব। নিশ্চয় ওকে উদ্ধার করতে এসেছে তার বন্ধুরা।
ইউ এফ ও পেল কোথায়? হাইজ্যাক করেছে! আর কোনভাবে। পাওয়া তো সম্ভব নয়।
ওদের দিকে দৌড় দিল সে।
.
২৪.
মিনিট পনেরো পর।
সিসি আর হেনরিকে নিয়ে আসতে রওনা হলো কিশোর। তার সঙ্গে চলল রবিন। বাকি তিনজন মহাকাশযানটার কাছে পাহারায় রইল।
খোঁড়লের কাছে পৌঁছে সিসি আর হেনরিকে বেরিয়ে আসতে বলল কিশোর।
বেরোল দুজনে।
রবিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। খুশির সংবাদ দিল সিসি আর হেনরিকে-আর ওদেরকে মিছিলে যোগ দিয়ে কষ্ট করে পাহাড় পেরোতে হবে না। মহাকাশযানে করেই দেশে ফিরে যেতে পারবে।
সিসি খুশি হলো, কিন্তু হেনরি হলো না। হঠাৎ ঘুরে এক দৌড় মারল বনের দিকে
হেনরি! কোথায় যাচ্ছ, হেনরি! ওর পিছু নিতে গেল অবাক কিশোর।
তার হাত চেপে ধরল সিসি। থাক, যেতে দাও। বাধা দিও না।
আরও অবাক হলো কিশোর। বাধা দেব না মানে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিসি বলল, সে অনেক কথা। চলো, যেতে যেতে বলছি।
হাঁটতে হাঁটতে যে কথা বলল সিসি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। কিশোরের। অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, আর কত চমক অপেক্ষা করছে! জিজ্ঞেস করল, কবে থেকে বুঝতে পারলে তুমি?
যেদিন হার্ট আঙ্কেল আর তার কোরিআন্টিকে খুন করল হেনরি, জবাব দিল সিসি। সেদিনই বুঝলাম, আঙ্কেলের শিক্ষার কোন প্রয়োজন ছিল না তার। জন্ম থেকেই সে নানা বিদ্যায় পারদর্শী।
তারমানে বর্ণ ঈভুল! বিড়বিড় করল কিশোর। জন্ম-পিশাচ!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল সিসি। আমার মায়ের পেটে জন্মালে কি হবে, সত্যিকার অর্থে ও আমার ভাই নয়। শয়তান। মা-বাবার রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারেও ওর হাত আছে কিনা কে জানে! তবে ঘোড়াগুলোকে সে-ই যে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে খেপিয়ে তুলেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনে মনে কথা বলেছে ওদের সঙ্গে। আমাদের উপকার করার জন্যে করেনি এ কাজ, নিজের স্বার্থে করেছে।…এই যে, এখন, যেই এখান থেকে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো, অমনি পালিয়েছে। ও এখান থেকে যাবে না।
বুঝে থাকলে এতদিন বলোনি কেন? ভয়ে। যাকে ও শত্রু মনে করবে, নিষ্ঠুর ভাবে শেষ করে দেবে।
মহাকাশযানের কাছে পৌঁছে গেল ওরা।
সিসি বলল, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। হেনরিকে বিশ্বাস নেই। কখন এসে হাজির হবে শয়তানির মতলব নিয়ে বলা যায় না। আমরা সবাই এখন তার শক্র। জলদি করো।
সিসির ধারণাই ঠিক।
মহাকাশযানে উঠে পড়েছে সবাই। সিঁড়িটা সবে তুলেছে, এই সময় বনভূমি কাঁপিয়ে দিয়ে শোনা গেল সম্মিলিত গর্জন। অন্ধকারে অসংখ্য চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখল কিশোর। নেকড়ের পাল নিয়ে ওদের ধ্বংস করতে এসে হাজির হয়েছে হেনরি। সবচেয়ে বড় নেকড়েটার পিঠে চড়ে এসেছে সে। ছোটখাট একটা ঘোড়ার সমান নেকড়েটা। শয়তানের উপযুক্ত বাহন। ধকধক করে। জ্বলছে নেকড়েগুলোর চোখ।
জলদি করো! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সিসি। ধরতে পারলে রক্ষা থাকবে না আমাদের কারও!
সুইচ টিপে দিল রিটা। বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল হ্যাঁচের ঢাকনা। কানফাটা গর্জন করে ওটার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বড় নেকড়েটা। কিন্তু মুখ ঢোকানোর আগেই বন্ধ হয়ে গেল ঢাকনা।
দেরি কোরো না! সিসি বলল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে এখান থেকে। শয়তানের কুবুদ্ধির অভাব হয় না!
ইঞ্জিন চালুই আছে। অটো পাইলট অন করে দিল মুসা।
*
আমার বিশ্বাস, এটা মহাকাশযান নয়, কিশোর বলল। অতি আধুনিক কোন আকাশযান। পৃথিবীর মানুষের তৈরি।
রকি বীচে ফিরে চলেছে ওরা।
এখন অবশ্য আমারও তাই মনে হচ্ছে, মনিটরের দিক থেকে চোখ সরাল না মুসা।
কে বানাল? রবিনের প্রশ্ন।
কোন অতি বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী, জবাব দিল কিশোর। যা শুনলাম তোমাদের কাছে, তাতে একজনের কথাই মনে আসছে আমার-ডক্টর মুন। ভিনগ্রহবাসী বলে যাদের ধারণা করেছ তোমরা, তারা আসলে রোবট। জ্যান্ত মানুষকে নানাভাবে উন্নত করে রোবট বানিয়েছে সে। তার বশংবদ ভৃত্য করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তার লোকেরাই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেরাতে। তার কাজে বাদ সাধায় আমাদের ওপর একটা আক্রোশ তো তার বরাবরই আছে। এখন মনে হচ্ছে, আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কোনভাবে আমার মগজটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে। দুঃস্বপ্ন ভেবেছি যে সব ঘটনাকে, আসলে ওগুলো দুঃস্বপ্ন ছিল, ঘোরের মধ্যেই করেছি, ওসব কাজ। রেগেমেগে শেষে সে আমাকে কাচু-পিকচুতে দ্বীপান্তর দিয়েছিল?