ও চলে গেল। ডাকলেই আবার আসবে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সিসি বলল, কিশোরভাই, কাল আমরা কোথায় যাব? ভেবেছ কিছু?
কি আর ভাবব, বলো? কাফেলায় ঢুকে পড়াই উচিত।
ওই এতিমদের মিছিলে! ফকিরের মত ভিক্ষে করতে করতে যাব? রাগত স্বরে বলল সিসি, কিশোরভাই, তুমি বলেছিলে আমাদেরকে এতিমের মিছিলে ঢোকাবে না।
বোঝার চেষ্টা করো, সিসি, আর কোন উপায় নেই এখন। আমাদের, বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। ফার্মে ফিরে যেতে পারছি না। কাল রাতে যা ঘটে গেছে, এর পর গাঁয়ের পথে আমাদের দেখামাত্র ধরে নিয়ে গিয়ে হয় পুড়িয়ে মারবে, নয়তো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে লোকে। কেউ কোন কথা শুনবে না। তা ছাড়া ফিরে যাবই বা কোথায়? বাড়িঘর কি আর আছে? সব তো পোড়া ছাই। তারচেয়ে এই জঘন্য জায়গা থেকে বেরিয়ে চলে যাব আমরা।
কোথায় যাব? সিসির প্রশ্ন।
উত্তর আমেরিকায়। সেখানে আমাদের বাড়ি আছে, আমার চাচা আছে, চাচী আছে; কোন অসুবিধে হবে না তোমাদের। সুখেই থাকতে পারবে।
আমি তো জানতাম দক্ষিণ আমেরিকারই অন্য এক শহর থেকে এসেছ তুমি। তাই তো বলেছিলে।
মিথ্যে বলেছিলাম। কারণ আমি এখনও জানি না, এখানে কিভাবে এসেছি। আর আমার যেটা সন্দেহ, সেটা আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমাদের আর কি বলব!
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল সিসি। কিন্তু আমি কারও গলগ্রহ হতে চাই না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে। আমি বড় হয়ে গেছি। নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে পারব।
কথার শব্দে হেনরির ঘুমও ভেঙে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে তার। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। বোনের কথা সমর্থন করেই যেন সে-ও জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল ওপরে-নিচে।
পারবে না, তা তো বলছি না। কিন্তু পারার জন্যে একটা স্বাভাবিক পরিবেশ চাই। সেটা কোথায় এখানে থাকা তো দূরের কথা, গায়ের লোকের চোখে পড়লেও মরতে হবে।
কোনভাবে ওদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে থাকতে যদি পারতাম, ভাল হত! সিসি যেতে চায় না কেন, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিশোরের। নিজের জন্মভূমি, এতকালের বাসস্থান ফেলে কে-ই বা যেতে চায়!
বোনকে সমর্থন করে আবার জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল হেনরি।
লং হার্টকে আমি কথা দিয়েছিলাম, কিশোর বলল, আমি তোমাদের ফেলে যাব না। তোমাদের দেখব।
কিন্তু সেই কথা আর রাখতে পারছ না, কেঁপে উঠল সিসির গলা।
পারলাম না কোথায়? আমি তো তোমাদের ফেলে যাচ্ছি না। সঙ্গেই যাচ্ছি। বরং নিয়ে যাচ্ছি এমন একখানে, যেটা এখানকার চেয়ে হাজারগুণ ভাল।
জোরে জোরে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল হেনরি, সে যেতে চায় না, হাজারগুণ ভাল হলেও না। সে এখানেই থাকতে চায়।
তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে কিশোর বলল, ভাবনা নেই, হেনরি, আবার আসব আমরা এখানে। তবে অসহায় হয়ে নয়, শক্তি সঞ্চয় করে, টাকা-পয়সা নিয়ে, যাতে সমানে সমানে বাধা দিতে পারি ফ্রেঞ্চদের। শয়তান গ্যারিবাল্ড আর টাকার জন্যে মোচড় দিয়ে আমাদের দুর্বল করে ফেলতে না পারে…
কথা শেষ হলো না তার। কানে এল ইঞ্জিনের শব্দ। অবাক হয়ে কান পাতল। খানিক পরে উজ্জ্বল আলো দেখতে পেল গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে। আশ্চর্য! এতরাতে বনের মধ্যে আলো কিসের? দলবল নিয়ে ওদের খুঁজতে এল গাঁয়ের লোকে? কিন্তু ইঞ্জিন! নাহ, দেখতেই হচ্ছে।
তাড়াহুড়ো করে খোড়ল থেকে বেরিয়ে এল সে।
কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল সিসি।
দেখে আসি।
আমরাও আসছি।
না, তোমরা ওখানে বসে থাকো…
কিন্তু…
হাসল কিশোর। এইমাত্র না বললে নিজেদের দেখাশোনা করার মত যথেষ্ট বড় হয়েছ তোমরা? বসে থাকে। আমি যাব, আর আসব।
উঠে দাঁড়াতে গেল সে। সোজা থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ভাজ হয়ে যেতে চাইছে হাঁটু। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে ডলতে শুরু করল খিচ ধরা মাংসপেশি। হাত-পা ঝাড়তে লাগল।
মানুষের কণ্ঠ কানে ল।
দূর থেকে। আর দেরি করল না সে। রওনা হয়ে গেল বনের ভেতর দিয়ে।
*
থেমে গেছে মহাকাশযান। স্বচ্ছ গম্বুজ দিয়ে এখনও রাতের কালো আকাশ চোখে পড়ছে। তবে অন্ধকারটা এখানে অনেক বেশি। তারা দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর আকাশের মতই। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো, চাঁদও দেখা যাচ্ছে।
এ কোন্ গ্রহে নামল ওরা?-ভাবছে রবিন। তবে কি টুইন আর্থ আছে যে, এ কথা সত্যি? অবিকল পৃথিবীর মত আরেকটা যে গ্রহের কথা শোনা যায়, সেখানে এসে নামল ওরা? বেরোলেই বোঝা যাবে।
অন্য তিনজনের সঙ্গে আলোচনা করে হ্যাঁচের সুইচ টিপে দিল রিটা।
খুলে গেল হ্যাচ। নিঃশব্দে নেমে যেতে লাগল সিঁড়ি।
গর্তের মুখটা খুলে হুড়মুড় করে এসে ভেতরে ঢুকল রাতের তাজা বাতাস। ঠাণ্ডা, ভেজা ভেজা। বুক ভরে শ্বাস নিল ওরা।
আহ, দারুণ আরাম! মুসা বলল। পৃথিবীর চেয়ে কোন অংশে কম না।
মই বেয়ে মাটিতে নামল সবাই। খুব সতর্ক। বিপদের সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়বে স্পেস শিপে।
চারপাশে ঘন গাছপালা। ঘন বন। পেঁচার ডাক কানে এল। দূরে নেকড়ে ডাকল।
খাইছে! বলে উঠল মুসা, এ তো এক্কেবারে পৃথিবীর মত!
আমিও তাই ভাবছিলাম, জবাব দিল রবিন। শিওর, এটা সেই টুইন আর্থ। পৃথিবীর যমজ বলা হয় যে গ্রহটাকে, অনেক বিজ্ঞানীই এখন এটার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন…
বনের মধ্যে খসখস শব্দ হলো।
সবার আগে শুনতে পেল মুসা। ঝট করে ফিরে তাকাল সেদিকে। অন্ধকারের মধ্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, কে যেন আসছে!