সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। সিসির কোন ক্ষতি করতে.. দেবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে খোড়লের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। কয়েক ফুট দূরে দেখা গেল সিসিকে। ঘন ডালপাতা ভেদ করে। চাঁদের আলোর আবছা আভা এসে অদ্ভুত আলো-আঁধারি সৃষ্টি করেছে তাকে ঘিরে।
ছায়া থেকে বেরিয়ে এল জ্বলন্ত চোখজোড়া।
চাপা গর্জন করে উঠল। ভারী গর্জন।
নেকড়ে!
সাপের মত নিঃশব্দে অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে এল ওটা। কাঁপতে লাগল কিশোর। লম্বা, শক্তিশালী দেহটা এগিয়ে আসছে সিসির দিকে।
অত বড় জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করে পারবে না। দৌড় দিয়েও লাভ নেই।
নেকড়ের মুখটা স্পষ্ট হতেই হাঁ হয়ে গেল কিশোর। একটা মরা খরগোশ দাঁতে ঝুলছে।
ধীরে ধীরে সিসির দিকে এগোচ্ছে সাদা প্রাণীটা। চাঁদের আলোয় রূপালী লাগছে। সিসির কাছে এসে মাথা নিচু করল। খরগোশটা সিসির পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল মাটিতে।
পালাও, সিসি! দৌড় দাও! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল কিশোরের। নেকড়ের ভয়ে বলতে পারল না। সিসিকে নেকড়েটার পাশে শুয়ে পড়তে দেখে দম আটকে এল তার। চিৎকারটা ঠেলে উঠে আসতে চাইছে গলার কাছে, বহু কষ্টে নিচে নামাল।
মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখছে, আস্তে করে একটা হাত রাখল। সিসি নেকড়েটার ঘাড়ে। ধীরে ধীরে নিজের মুখটা নিয়ে গেল। সেদিকে। ওটার রোমশ চামড়ায় গাল রাখল সে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
সিসির সেই নেকড়েটা!
গাঁয়ের লোকে কি তাহলে ঠিকই বলে? জন্তু-জানোয়ারকে বশ করার অশুভ ক্ষমতা আছে সিসির? উঁহু! মেনে নিতে পারল না সে। যেটা আছে, স্বেটা ভাল ক্ষমতা। জানোয়ারের বিশ্বাস অর্জন করে নিতে পারে। ওদের ভালবাসে, বোঝাতে পারে। যে ক্ষমতা ছিল লং জন হার্টের। তাতে অশুভ কোন ব্যাপার নেই।
খসখস শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিশোর। হেনরিও বেরিয়ে এসেছে। সিসি আর নেকড়েটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।
ভয় নেই, হেনরি, কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল কিশোর। এটা সিসির সেই বন্ধু নেকড়েটা। খরগোশ শিকার করে এনে দিয়েছে খাওয়ার জন্যে।
নেকড়েটার দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে হেনরি।
এখনও তার ভয় যাচ্ছে না ভেবে কিশোর বলল, নেকড়েটা কোনভাবে বুঝতে পেরেছে বিপদে পড়েছে তার বন্ধু। বাড়িতে সেদিন মাংস খাওয়াতে দেখে। পরে আমি সিসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বনের মধ্যে বাচ্চা অবস্থায় নাকি ওটাকে দেখতে পেয়েছিল সিসি। ওটার মা মরে গিয়েছিল। খাবার দিয়ে, আরও নানা ভাবে সাহায্য করে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সিসি। বড় হয়ে বিপদের দিনে এখন বন্ধুকে সাহায্য করে প্রতিদান দিতে এসেছে নেকড়েটা।
মাথা ঝাঁকাল হেনরি। ক্লান্ত চোখের পাতা উলল। তাকে আবার খোড়লের মধ্যে নিয়ে গেল কিশোর। তার কোলের মধ্যে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল হেনরি।
সিসির দিকে তাকাল কিশোর। নেকড়ের কোলের কাছে কুঁকড়ে শুয়ে, গায়ে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে সিসি।
খোড়লের দেয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে কিশোরও ঘুমিয়ে পড়ল।
২৩.
ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কেন ভাঙল? বুঝতে পারল না।
দম বন্ধ করে, কান পেতে রইল।
বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। নেকড়েটা চলে গেছে। খোড়লের মধ্যে কিশোরের পাশে এখন শুয়ে আছে সিসি। গভীর ঘুমে অচেতন।
নড়েচড়ে আরাম করে বসল কিশোর। চোখ বুজল। কিন্তু আর আসছে না ঘুম।
হাজারটা ভাবনা ভীড় করে এল মনে। কি করবে সকাল হলে? এই খোড়লে অনন্তকাল ধরে বসে থাকা যাবে না। আলো ফুটলে ফ্রেঞ্চরা দলবল নিয়ে ছুটে আসবে। পকেটে একটা পয়সা নেই। খাবার নেই। পরনের কাপড়ের হালও বড় করুণ। কি করে বাঁচাবে হেনরি আর সিসিকে?
কান পেতে শুনছে বাতাসে গাছের পাতার ফিসফিসানি। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে চলেছে যেন। কিন্তু ঘুম আর তার কোনমতেই এল না। ভেবেই চলেছে। রহস্যময় কতগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছে না সে। মেলাতে পারছে না। এই যেমন, নেকড়ের কথাই ধরা যাক। এতদিন জেনে এসেছে, আন্ডিজ পর্বতমালায় নেকড়ে নেই। তাহলে এ বনেরগুলো এল কোথা থেকে? গায়ের লোকে বলে, সিসির অশুভ ক্ষমতা আছে। জন আর মার্ক ফ্রেঞ্চের ঘোড়াগুলোকে খেপিয়ে তুলেছিল সে। ওদের কথা ঠিক নয়-সিসি কিছু করেনি, কিশোর অন্তত বিশ্বাস করে না; কিন্তু তাহলে ওভাবে খেপল কেন ঘোড়াগুলো? অস্বাভাবিক ঘটনা। তারপর আজকে, দুই ভাইয়ের ঘোড়া দুটো প্রাণের মায়া না করে যে ভাবে ছুটে গেল আগুনের মধ্যে, তাতে যে কেউ বলবে উস্কানি দিয়ে ওগুলোকে সেদিকে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তারপর রয়েছে লং জন হার্ট আর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুটা। গাড়ির ঘোড়াগুলো সেদিনও যেন অদৃশ্য কারও নির্দেশে সোজা খাদের দিকে ধেয়ে গিয়েছিল, নিজেদের প্রাণের পরোয়া না করে। তিনটে ব্যাপারকে এক করে দেখলে একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যায়-মোটেও স্বাভাবিক নয় ঘটনাগুলো; এ সবের পেছনে কারও কোন হাত নেই, এটা বললেই বরং মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া সিসি আর হেনরির মা-বাবা…
কিশোরভাই, তুমি ঘুমাচ্ছ না? সিসির কথায় বাস্তবে ফিরে এল কিশোর।
তুমিও তো ঘুমাচ্ছ না।
ভেঙে গেল ঘুমটা। এভাবে কি ঘুমানো যায়?
বাইরেই তো ভাল ছিলে। নেকড়ে-বন্ধুর সঙ্গে। খোড়লে ঢুকলে কেন?