কোথায় যাব? মৃদু স্বরে জানতে চাইল সিসি।
বড় করে দম নিল কিশোর। বনের মধ্যে কাটিয়ে দেব আজকের রাতটা। কাল একটা বুদ্ধি বের করব।
তার প্যান্ট খামচে ধরল হেনরি। চোখ নামাল কিশোর। হেনরির ছোট্ট তুলতুলে গালে ছাই আর কালি লেগে আছে। সবুজ চোখ দুটো অনেক বড় লাগছে এখন, টলটলে, যেন গভীর দীঘির পানি। ঝুলে পড়েছে ছোট ছোট কাধ।
এখানে থাকব না আমরা, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে কিশোরের, দিনু তবু দুই হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল হেনরিকে। থাকলে, মরতে হবে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বনের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। সিসি, আমার শার্ট ধরে রাখো। কোন কারণেই আলাদা হবে না।
বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। চাঁদের আলোকে আড়াল করে। রেখেছে গাছপালার ঘন ডাল-পাতা।
পেছন থেকে শার্ট ধরে হাঁটতে গিয়ে বার বার কিশোরের পায়ে হোঁচট খাচ্ছে সিসি, গায়ের ওপর এসে পড়ছে। কাঁধে বসা হেনরি দুই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে গলা। এ অবস্থায় হাঁটা খুব কঠিন হয়ে উঠেছে কিশোরের জন্যে।
আরেক বার হোঁচট খেয়ে সিসি বলল, সরি, কিশোরভাই, দেখতে পাচ্ছি না।
হয়েছে, জবাব দিল কিশোর, হাঁটার গতি এবার কমানো যায়।
বনের মধ্যে এত অন্ধকার, বাপরে! গলা কেঁপে উঠল সিসির।
গাছের ডাল থেকে শূন্যে ঝাঁপ দিল একটা পেঁচা। মুহূর্ত পরেই আক্রান্ত ইঁদুরের তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার শোনা গেল। শিকার নিয়ে অন্য ডালে গিয়ে বসল আবার পেঁচাটা।
এরপর ভারী নীরবতা।
অন্ধকারে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করছে কিশোর। তার মনে হচ্ছে বনের সব হিংস্র জানোয়ারের চোখ এখন ওদের দিকে। যে কোন মুহূর্তে ইঁদুরটার যা গতিক হয়েছে, ওদেরও তা-ই হবে।
হেনরিকে এক কাঁধের ওপর বসাল সে। আগে বাড়তে গিয়ে পায়ের নিচে মট করে ভাঙল শুকনো ডাল।
সড়সড় করে দৌড়ে চলে গেল কি যেন। আরেকটা ইঁদুর হবে, ভাবল সে। কিংবা অন্য কোন ছোট প্রাণী। কাঠবিড়ালীও হতে পারে। নিরীহ-নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করল। ক্ষতি করবে না।
হাঁটতে থাকো, সিসিকে বলল সে।
বনের মধ্যে বাতাস ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা। যতই গভীরে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাড়ছে। গাছের ডাল-পাতা এড়িয়ে চলার উপায় নেই। গায়ের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে। পায়ের নিচে ঝরা পাতার পুরু কার্পেট।
কানের কাছে হেনরির নিঃশ্বাস আর সিসির হাঁপানোর শব্দ ছাড়াও আরেকটা শব্দ কানে এল কিশোরের।
দাঁড়িয়ে গেল।
কি হলো? জানতে চাইল সিসি।
চুপ! চাপা গলায় বলল সে। শব্দ!
কিসের? কিসের শব্দ?
কথা বোলো না। দম বন্ধ করে রাখো। হেনরি, তুমিও।
কান পেতে রইল কিশোর। কিছু শুনল না। অবশেষে ছেড়ে দিল দমটা।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে শুনল সিসিকে।
আবার হাঁটতে লাগল ওরা। কিছুদূর এগিয়ে কিশোর বলল, সামনে মনে হচ্ছে থামার জায়গা পাব।
ছোট একটা জায়গায় গাছপালা সামান্য পাতলা। চাঁদের আলো এসে পড়ছে মাটিতে। বেশি না, তবে দেখার জন্যে যথেষ্ট। বড় একটা গাছ কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। মস্ত খোড়ল।
ওতে ঢুকে লুকিয়ে থাকা যাবে, খোড়লটা দেখিয়ে বলল কিশোর। হেনরিকে নামিয়ে দিল কাধ থেকে।
হামাগুড়ি দিয়ে তাতে ঢুকে গেল হেনরি।
তারপর ঢুকল সিসি। উঁহ, ভয়ানক গন্ধ!
ও কিছু না। পচা কাঠের গন্ধ, অধৈর্য কণ্ঠে বলল কিশোর। গন্ধ তোমার কোন ক্ষতি করবে না।
সে নিজেও ঢুকে পড়ল খোড়লে। পা লম্বা করা যাচ্ছে না। মুড়ে নিয়ে এল বুকের কাছে। সারা শরীরে অকল্পনীয় ব্যথা।
ফার্মে আর ফিরে যেতে পারবে না। রাতটা কোনমতে নিরাপদে কাটাতে পারলে আগামীকাল ভেবে দেখবে কি করা যায়।
পাতায় পাতায় কাঁপন তুলে বয়ে গেল এক ঝলক বাতাস। কি যেন গোপন কথা বলে গেল পরস্পরকে ফিসফিস কানাকানি করে। ডালে ডালে ঘষা খেয়ে বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি করল।
জেগে বসে পাহারা দেয়া দরকার। কিন্তু কোনমতেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না আর। দশ মণ ভারী হয়ে আসছে যেন চোখের পাতা।
আরেকটু আরাম করে বসার জন্যে নড়েচড়ে সোজা করল। মাথাটা, নজর পড়ল সামনে গাছের বেড়ার মাঝে অন্ধকার ছায়ার দিকে।
জ্বলন্ত দুটো হলুদ চোখ সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে।
.
২২.
আতঙ্কিত চিৎকারটা মুখ থেকে বেরোতে দিল না কিশোর। ঢাক গিলে নামিয়ে দিল বহু কষ্টে।
কিসের চোখ? নেকড়ে? ভালুক? পাহাড়ী সিংহ? ভয়ঙ্কর সব হিংস্র জন্তুর চেহারা খেলে যেতে লাগল মনের পর্দায়। সঙ্গে বন্দুক নেই। আত্মরক্ষার উপায় নেই।
আমাকে দেখেনি! নাকি দেখেছে? ভাবনাগুলো এলোমেলো আঘাত হানতে লাগল যেন মগজের মধ্যে। আমরা যে আছি খোড়লের মধ্যে, সেটাই জানে না!
বুকের মধ্যে ধুড়স ধুড়স করছে হৃৎপিণ্ডটা। গলা শুকিয়ে কাঠ। পিছিয়ে আসতে গেল।
আউ! চিৎকার করে উঠল সিসি। কি করছ?
চুপ! নিচু স্বরে সাবধান করল কিশোর। বললাম না তখন, একটা শব্দ শুনেছি!…পিছে পিছে চলে এসেছে ওটা। আমাদের খুঁজছে এখন।
কোথায়? এগোতে গিয়ে জায়গা না পেয়ে কিশোরের পায়ের ওপর চেপে বসল সিসি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর বেরিয়ে যেতে শুরু করল।
ধরার জন্যে থাবা মারল কিশোর। স্কার্ট চেপে ধরতে গেল। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পিছলে গেল কাপড়। ধরে রাখতে পারল না। বেরিয়ে গেছে সিসি।
সিসি! জলদি ভেতরে ঢোকে।
ইঁদুরটার আর্তচিৎকারের কথা মনে পড়ল, কিশোরের। সিসিকে কি করবে এই প্রাণীটা?