মেঘ থেকে বেরিয়ে এল মহাকাশযান। আরও ওপরে উঠল। আকাশটা এখন শুধুই কালো। গম্বুজের ভেতর দিয়ে তারাগুলোকে বড় বড় লাগছে, তবে কিছুটা ঘোলাটে।
রবিন ভাবছে, পৃথিবীর সীমানা কি ছাড়িয়ে এল? মহাকাশটাকে দেখতে কি এমনই লাগে? বিমান থেকে যে রকম দেখা যায়, তার সঙ্গে এখনকার আকাশের তেমন কোন তফাৎ খুঁজে পেল না সে। হতে পারে পৃথিবীর সীমানা এখনও কাটায়ইনি। মহাকাশযান।
কখন কাটাবে? চলছে যে তাতে কোন সন্দেহই নেই।
ওপরে ওঠার সময় নিচের দিকে যেভাবে টানছিল মাধ্যাকর্ষণ, যে কারণে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল ওরা, সেই টানটা আর এখন নেই। উঠে দাঁড়াল রবিন। দেখাদেখি জিনা আর রিটাও উঠল।
মুসার কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। চালাতে তাহলে পারছ।
রিটা আর জিনাও এগিয়ে এল। ঘিরে দাঁড়াল মুসাকে।
চালানো-টালানোর ব্যাপারে তুমি তো একটা জিনিয়াস, প্রশংসা করল রিটা। প্লেন চালাতে পারো জানতাম। কিন্তু ভাবতেই পারিনি স্পেস শিও চালাতে পারবে। কি করে বুঝলে?
খুব সহজ, হাসতে হাসতে জবাব দিল মুসা। কেবিনের আলোয় ঝকঝক করতে থাকল তার সাদা দাঁত। রহস্যটা ফাঁস করে দিলেই বুঝবে, একটা বাচ্চা ছেলেও চালাতে পারবে এটা। আমি শুধু অটো পাইলট চালু করে দিয়েছি।
তারমানে নিজে নিজে চলছে এখন এটা? ভুরু কুঁচকে ফেলল জিনা। কোর্স যেখানে সেট করে রাখা আছে সেখানেই গিয়ে নামবে? ও মাথা ঝকাল মুসা। তাই তো করার কথা। পৃথিবীতে মানুষের তৈরি প্লেন, জাহাজ তা-ই করে।
কাজটা কি ঠিক হবে? রিটার প্রশ্ন।
না হওয়ারই বা কি হলো? অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। প্রাণে তো বাচলাম।
কই আর বাঁচলাম, রবিন বলল। মলের লোকগুলোর হাত থেকে বেঁচেছি। কিন্তু গিয়ে তো নামতে হবে ওদেরই দেশে। অর্থাৎ, শত্রুর দেশে। কোন গ্রহে যাচ্ছি, ওখানকার কোন কিছুই না। জেনে হুট করে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
তা তো হবেই না, হাসিটা মুছে গেল মুসার। কিন্তু আর কি করতে পারি!
কিছু একটা উপায় বের করা দরকার, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই, চিন্তিত স্বরে বলল রবিন।
করো, করো, যা করার জলদি করো। ভাবাভাবিগুলো আমার কর্ম নয়। আমাকে যে ভাবে চালাতে বলবে, আমি সেভাবেই চালাব।
তারচেয়ে এক কাজ করি বরং, রিটা বলল। যে ভাবে চলছে। এটা চলতে থাকুক। দেখি না কোনখানে গিয়ে থামে। জায়গাটা দেখে নেয়া দরকার। তারপর আবার অটে। পাইলট চালু করে সহজেই পৃথিবীতে ফিরে আসা যাবে।
তা ঠিক, মাথা ঝকাল রবিন। বুদ্ধিটা মন্দ না।
হ্যাঁ, সুযোগ যখন একটা পাওয়াই গেল, জিনার কণ্ঠেও উত্তেজনা, গ্রহটা দেখে এলে মন্দ কি?
সীটে হেলান দিল মুসা, আমি রাজি।
২১.
কিশোরের গলা থেকে ফাঁসটা খুলে নিল মার্ক। খিকখিক করে হাসল। না, অত সহজে মারব না। এত তাড়াতাড়ি মেরে ফেললে মজাটা আর রইল কোথায়…
হঠাৎ চালার একটা জ্বলন্ত অংশ খসে পড়ল মাটিতে।
ঘাবড়ে গিয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঘোড়াগুলো। চোখ উল্টে দিয়েছে। ওগুলোর কালো চোখে আতঙ্ক।
হেনরির হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরে সরিয়ে নিল কিশোর।
ঘোড়াগুলোকে সামলাতে পারল না সওয়ারিরা! ভয়ে চিৎকার করতে করতে অন্ধকারে ছোটাছুটি শুরু করল ওদের বাহনগুলো। জিন আঁকড়ে বসে রইল কেউ, কেউ বা ঝুলে রইল একপাশে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অস্থির।
মাটিতে পড়তে পড়তে জিনে আটকে গেল জন ফেঞ্চের ভাঙা হাতের স্লিং। পা পড়ে গেছে মাটিতে। হিঁচড়ে নিয়ে তাকে দৌড় বাড়িটার দিকে। একই রকম অদ্ভুত কাণ্ড করল মার্কের ঘোড়াটাও। সওয়ারি নিয়ে সোজা জ্বলন্ত বাড়ির দিকে দৌড়। ঠিক এই সময় চালার আরও একটা বিরাট অংশ ভেঙে পড়ল ওদের ওপর। আগুন গ্রাস করে নিল ওদের। মাথা ঝাড়া দিতে দিতে একটা ঘোড়াকে কোনমতে আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল কিশোর। কেশরে আগুন ধরে গেছে। মার্ক ফ্রেঞ্চ নেই তার পিঠে।
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে দুচারজন সাহসী যা ছিল দলে, তারাও আর দেরি করল না। হয় ঘোড়ার পিঠে বসে, নয়তো লাফ দিয়ে। মাটিতে পড়ে দৌড়ে পালাতে লাগল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে।
চোখের পলকে খালি হয়ে গেল জায়গাটা। আগুনের হলুদ আলোয় আলোকিত।
গর্দভের দল! বিড়বিড় করে বলল সিসি। ঘোড়া যে আগুনকে ভয় পায়, ভুলেই গিয়েছিল ওরা!
হ্যাঁ, বিমূঢ় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, আগুনের এত কাছে আসা উচিত হয়নি ওদের।
জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে চোখ তুলে তাকাল সে। জন বা মার্ক বেরিয়ে আসছে কিনা দেখছে। ওদের ঘোড়া দুটো পালিয়েছে। একটার পিঠেও সওয়ারি ছিল না। চালার নিচে চাপা পড়েছে দুই ভাই। জ্ঞান হারিয়ে থাকলে সব সাহায্যের বাইরে চলে গেছে ওরা এতক্ষণে। গায়ে কাঁটা দিল তার। সিসি আর হেনরির কাঁধে দুই হাত রেখে যেন সাহস সঞ্চয় করতে চাইল।
আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই উঠে যাচ্ছে ওপরে। লোভী দানবের মত পুরো বাড়িটাকে গিলে নিয়েছে।
পালানো দরকার! সংবিৎ ফিরে পেল যেন কিশোর হঠাৎ লোকগুলো শীঘ্রি ফিরে আসবে, মার্ক আর জনের কি হয়েছে। দেখতে। দুই ভাই বেঁচে থাকলেও আমাদের ছাড়বে না, আর মরে গেলে তো খেপা কুকুর হয়ে যাবে ওদের পরিবারের লোকজন।
কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? এই এলাকায় কে সাহায্য করবে তাকে? খাবার নেই। পকেটে একটা পয়সা নেই। রাইফেলটাও গেছে ঘরের সঙ্গে সঙ্গে।