একটা চারকোনা বোতাম টিপে দিতেই নিঃশব্দে ওপরে উঠে গেল টিউবগুলো। যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে মেঝের ওপর দিয়ে তার দিকে হেঁটে এল মুসা, রবিন আর জিনা।
অনেক ধন্যবাদ, রিটা, জিনা বলল। আমি জানতাম, তুমি আসবে।
ভেন্নাগুলোর কি অবস্থা? মুসা জানতে চাইল। বিপদ কি কাটল আমাদের?
এখনও কাটেনি, জবাব দিল রিটা।
তুমি ঢুকলে কি করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
লড়াই করেছি ওদের সঙ্গে। ওরা হেরেছে।
খাইছে! চোখ বড় হয়ে গেল মুসার। একা ওই পাঁচ-পাঁচটা। দৈত্যকে কাবু করে ফেললে!
নইলে কি আর আমাকে এখানে ঢুকতে দিত? তোমাদের মত ধরে নিয়ে আসত। এতক্ষণে আমিও বন্দি হয়ে যেতাম কোন একটা টিউবে।
কথা পরেও বলা যাবে, তাগাদা দিল জিনা। এখান থেকে পালানো দরকার।
গর্তটার কাছে এসে দাঁড়াল আবার সবাই। সুইচটা অন করে দিল রিটা। সরে গেল হ্যাঁচের ভারী ঢাকনাটা।
নিচে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ানক রেগে যাওয়া পাঁচজন ভিনগ্রহবাসী।
হ্যাচ লাগানোর জন্যে তাড়াতাড়ি আবার সুইচ টিপল রিটা।
আমি তো ভেবেছিলাম শয়তানগুলোকে মেরেই ফেলেছ বুঝি, ঢাকনাটা খাপে খাপে বসে যেতে বলল মুসা।
তারমানে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল, রিটা বলল।
বেশ। কোনভাবে তাহলে ওদের মনে করিয়ে দাও, শয়তানি করতে এলে আবার বেহুশ করা হবে।
ধুড়ম ধুড়ম করে বাড়ি পড়তে শুরু করল হঠাৎ মহাকাশযানের পেটে। হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারছে মনে হচ্ছে। ধাতুর পাত ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে ভিনগ্রহবাসীরা। সে-রাতে গাড়ির মধ্যে বসে থাকার কথা মনে পড়ল রিটার। গুণ্ডা ছেলেগুলো এসে গাড়িটাকে এ রকম করে পিটাচ্ছিল। তবে সেবার জন্মদিনের কেক মুখে। মাখিয়ে দিয়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছিল, এবার আর তত সহজ হবে না।
এই স্পেস শিপটা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল চেনে ওরা, রবিন বলল। আমরা কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ঠিকই ঢুকে পড়বে।
কি করব? রিটার প্রশ্ন।
এটা নিয়ে উড়ে চলে গেলেই হয়, সহজ জবাব দিয়ে দিল মুসা!
তা তো বটেই, পছন্দ হলো না জিনার। উড়ে চলে যাক। ভিনগ্রহে। শত্রুর দেশে। তারপর ফিরব কি করে?
যেতে পারলে ফিরতেও পারব, কন্ট্রোল প্যানেলে বসে পড়ল। মুসা। যা হবার হবে, সে পরে দেখা যাবে। আপাতত তো পালাই।
তা বটে, মুসার সঙ্গে একমত হলো রবিন। বাচতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ফুড কোর্টটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। কোনমতে যদি ঢুকতে পারে ওরা, দ্বিতীয়বার আর ঠেকাতে পারব না। স্রেফ খুন করে ফেলবে।
বেশ, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে মনোযোগ দিল মুসা, চালানো শুরু করলাম আমি।
.
২০.
রবিন, জিনা আর রিটা মহাকাশযানের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ধরার। মত যে যা পেল, শক্ত করে চেপে ধরল। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনের চেয়ারে সীট বেল্ট লাগানো আছে, সেটা পরে ফেলল। মুসা।
সমানে পিটিয়ে চলেছে ভিনগ্রহবাসীরা। বিকট শব্দ। সহ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে মহাকাশযানের ভেতরেই তৈরি হচ্ছে শব্দটা। সময় বেশি নেই, বুঝতে পারছে গোয়েন্দারা। শীঘি মারাত্মক জখম করে ফেলবে মহাকাশযানের শরীরে, হয়তো আর মাটি ছেড়ে যাওয়াই সম্ভব হবে না তখন। ওড়ার সময় যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে, দুর্বল জায়গা থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে মহাকাশযান।
সবাই রেডি? ভয়ানক শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল মুসা। রওনা হলাম!
কন্ট্রোলে হাত রাখল সে। কীবোর্ড নেই, স্টিয়ারিং হুইল নেই, শুধু দুটো ধাতব হাতের মত জিনিস। হাতের ছাপ নকল করে বানানো হয়েছে যেন। ওগুলোর ওপর হাত দুটো রাখল মুসা। বসে গেল সুন্দরমত। সঙ্গে সঙ্গে মনিটরে ফুটে উঠতে লাগল নানা রকম নম্বর আর লেখা।
আরও বেড়েছে বাড়ি মারার শব্দ। মরিয়া হয়ে উঠেছে ভিনগ্রহবাসীরা।
রেডি তো? জিজ্ঞেস করল মুসা। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে তিনজনকেই দেখল একনজর। আবার ফিরল কন্ট্রোলের দিকে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে নিজেকে। একটা অচেনা যানকে চালাতে ভয় যে পাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। চোখের দৃষ্টি মনিটরের ওপর স্থির। হাতের আঙুলগুলো অস্থির ভঙ্গিতে ওঠানামা করছে।
মহাকাশযানের গভীর থেকে চাপা গুমগুম শব্দ শোনা গেল। ক্রমেই বাড়তে থাকল শব্দটা। ভারী হচ্ছে। জোরাল হচ্ছে গুঞ্জন। বাইরের হাতুড়ি পেটানো থেমে গেল আচমকা। রাগে চিৎকার শুরু করেছে ভিনগ্রহবাসীরা। গোয়েন্দারা কি করতে যাচ্ছে, বুঝে গেছে।
গুঞ্জনটা তীক্ষ্ণ হতে হতে যেন আর্তনাদে রূপ নিল। দুলে উঠল মহাকাশযান। পরক্ষণে ঝাঁকি দিয়ে তীরবেগে ওপরে উঠতে শুরু করল।
কোন কিছু ধরেই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না তিনজনের পক্ষে। প্রচণ্ড গতিবেগের কারণে পড়ে গেল মেঝেতে। সেটে গেল যেন মেঝের সঙ্গে। নিজের ওজন দুই টন মনে হতে থাকল রিটার।
মাথার ওপরে গম্বুজের মত ছাতটা স্বচ্ছ হয়ে গেছে। কাঁচের বড় গামলার ভেতর দিয়ে তাকালে যেমন লাগে, তেমন লাগছে রাতের আকাশটাকে। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে রবিন, জিনা আর রিটা। কন্ট্রোল প্যানেলে ব্যস্ত থাকায় মুসা তাকাতে পারছে না। মলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাতের গর্ত দিয়ে তীব্রগতিতে বেরিয়ে এল মহাকাশযান। সোজা উঠে গেল মেঘের দিকে। জেট ইঞ্জিন। থেকে বেরোনো উজ্জ্বল রঙিন ধোয়া প্রতিফলিত হয়ে মেঘটাকেও রঙিন করে দিল। জলযান চলার সময় যেমন পেছনে দীর্ঘ একটা ঢেউয়ের রেখা সৃষ্টি করে রেখে যায়, তেমনি করে মহাকাশযানটা রেখে যাচ্ছে ধোয়ার লেজ। উজ্জ্বল লেজটা মুছে না যাওয়া পর্যন্ত রঙিন হয়ে থাকছে মেঘ, অনেকটা ধূমকেতুর পুচ্ছের মত।