বাঁচতে হলে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।
ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে গলা বাড়িয়ে তাকাতে লাগল সে। কোনদিকে যাবে? চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে আগুন।
সামনের দিকে যাও! চিৎকার করে উঠল আচমকা। সামনের ঘরটা দিয়ে বেরোতে হবে!
পায়ের কাছে লকলক করছে আগুনের শিখা। পরোয়া করল না। সোজা দৌড় দিল হলওয়ে ধরে সামনের বারান্দার দিকে। দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে সামনে এসে পড়ছে আগুন। ওগুলোর চারপাশে নাচানাচি করে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল। কিশোর। মুখের চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। ঝাঝাল ধোয়া চোখ পোড়াচ্ছে।
ছেলে-মেয়ে দুটোকে বের করে নিয়ে যেতেই হবে!-বার বার নিজেকে বলছে সে। ওদের বাঁচাতেই হবে।
দাঁড়িয়ে গেছে সিসি। তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। দিনের আলোর মত আলোকিত হয়ে গেছে ঘর। গাল বেয়ে পানি নামছে। কেঁদে ফেলল, বেরোনোর জায়গা নেই, কিশোরভাই!
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে কিশোরের হৃৎপিণ্ড পাগলের মত চারপাশে তাকাচ্ছে সে। পিছিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে আগুনের চাদর। সামনের দরজায় লাফালাফি করছে ছোট ছোট শিখা। মড়মড় শব্দ হলো। হাতের কড়িকাঠ ভাঙতে শুরু করেছে।
বাড়িটাকে আগুনের পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলতে আর বেশি দেরি নেই। যে কোন মুহূর্তে তাসের ঘরের মত ধসে পড়বে। চিড়ে-চ্যাপ্টী করবে ওদের। তারপর পুড়িয়ে ছাই করবে।
হেনরিকে পিঠ থেকে বুকের ওপর নিয়ে এল কিশোর। সিসিকে বলল, শক্ত করে আমার শার্ট চেপে ধরো। ওই দরজাটা। দিয়ে বেরোব।
দুই হাতে কিশোরের শার্ট খামচে ধরল সিসি। ফোপানি থামাতে পারছে না কোনমতে। হেনরিকে চেপে ধরে দরজার দিকে দৌড় দিল কিশোর। কাঁধের একপাশ দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল পুড়তে থাকা কাঠে।
ছুটে গেল কব্জা।
বাইরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। হেনরিকে ছাড়েনি। ওকে চত্বরে নামিয়ে দিয়ে ফিরে তাকাল সিসির অবস্থা। দেখার জন্যে। শেষ মুহূর্তে শার্ট থেকে সিসির হাত ছুটে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও পারল না কিশোর। বিপদ এখনও কাটেনি।
ঘোড়ার পিঠে চেপে ওদের তিনজনকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু। করল লোকগুলো।
ভেতরে থাকলেই ভাল করতে! ভয়ঙ্কর গলায় বলল মার্ক, তাড়াতাড়ি মরে যেতে। এখন মরবে ধীরে।
কাপুরুষের দল! চিৎকার করে উঠল কিশোর। আমরা কোন অন্যায় করিনি। সিসি নির্দোষ!
ঘিরে ফেলা চক্রটা ছোট করে আনতে লাগল লোকগুলো। ঘোড়ার গরম নিঃশ্বাস পড়তে লাগল কিশোরের মুখে। কাঁধে কাঁধ, গলায় গলা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে ওগুলো। ঘামের গন্ধ পাচ্ছে কিশোর। পশুগুলোর নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ এসে লাগছে নাকে।
পালানোর পথ নেই। ঘোড়ার পায়ের ফাঁক দিয়ে দৌড়াতে গেলে মাটিতে ফেলে খুর দিয়ে মাড়িয়ে তিলে তিলে শেষ করা হবে ওদের। : খসখসে কি যেন গলায় লাগতে ফিরে তাকাল কিশোর। চামড়ার ফালির একটা ফাস তার গলায় নামিয়ে দিচ্ছে মার্ক ফ্রেঞ্চ।
একটা জানোয়ারও আর অবশিষ্ট নেই তোমাদের, বলল সে। এবার তোমাদের পালা। সব কটাকে, ফাঁসিতে ঝোলাব। ইবলিসের ঝাড়-বংশ সব সাফ করে ফেলব।
১৯.
খেলনার দোকানটার দিকে ঘুরে তাকাল রিটা। শাটার নামানো। নীরব। অন্ধকার। রেগে যাওয়া ম্যানেজার নেই। বাচ্চা ছেলেটা নেই। কোন লোকই নেই।
অন্ধকার করিডরে চোখ বোলাল সে। রবিন কোথায়? মুসা? জিনা?
কয়েক মিনিট পরেই জানতে পারল, তার আশঙ্কাই ঠিক। বেরোতে পারেনি ওরা। সামনের অন্ধকারে, খাবারের দোকানটাতে হুটোপুটির শব্দ। বোধহয় লড়াই করছে।
দৌড় দিল রিটা। সামনের একটা ফোয়ারা থেকে পানি ভর্তি করে নিল সোকার গানটার ম্যাগাজিনে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, কাজ শেষ হয়ে গেলেই যাদের জিনিস আবার তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। জিনিস দিতে না পারলে, দামটা দিয়ে আসবে।
হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল পুরো মল। ভূমিকম্প শুরু হলো নাকি? না, ভূমিকম্প নয়, বড় কোন জেট প্লেন যাচ্ছে। তারপর মনে হলো, উঁহু, জেট প্লেনও নয়। অন্য কিছু।
কি শুরু হলো, এই মলে!
থামল না সে। খাবারের দোকানের কাছে এসে দেখল চেয়ার টেবিল সব উল্টে পড়ে ছত্রখান হয়ে আছে। কোনদিকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রবিনদের, বোঝা যায়।
না, বেরোতে ওরা পারেনি। শেষ মাথায় নিয়ে গিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে গার্ডেরা। পেছন দিকে হাত মুচড়ে ধরে দেয়ালের গায়ে চেপে ধরেছে মুসা, রবিন আর জিনাকে। নড়তেও কষ্ট হচ্ছে, ওদের। লড়াই শেষ। সবার মুখ ওপর দিকে।
কি দেখছে ওরা?
রিটাও স্কাইলাইটের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
হাঁ হয়ে গেল মুখ।
একটা ইউ এফ ও ফুড কোর্টের ওপর নেমে আসছে।
ভয়ানক শব্দে ভেঙে পড়ল স্কাইলাইটের কাঁচ। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল যানটা:। বিল্ডিঙের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওটার ভীষণ শক্তিশালী জেট ইঞ্জিন থেকে বেরোনো বাষ্প আর আগুনের হলকায় পুড়ে, গলে পানি হয়ে যেতে লাগল প্লাস্টিক। আগুন ধরে গেল চায়না-বান স্ট্যান্ডটায়। বৃষ্টির মত চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল কাঁচ, ধাতু আর কাঠের টুকরো। ভয়াবহ গরম হলকা এসে লাগল রিটার মুখে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যি একটা ইউ এফ ও নেমে এসেছে মলের ভেতরে।
ছয়টা ধাতব পা বেরিয়ে এল ওটার পেটের নিচ থেকে। পোড়া. মেঝেতে ছড়িয়ে বসল। খুলে গেল হ্যাচওয়ে। তীব্র সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। প্রায় নিঃশব্দে নেমে এল মইয়ের মত ধাতব সিঁড়ি।