বোকার মত তাকিয়ে রইলাম রাস্তার লোকজনের দিকে। ওরাও তাকাতে লাগল আমার দিকে। যেন আমি একটা কি!-পাগলা গারদ থেকে এইমাত্র ছাড়া পেলাম। গরমকালের পোশাক পরে আছি আমি। প্রচণ্ড উত্তেজনায় শীতও টের পাচ্ছি না।
মনে হলো, সব রহস্যের জবাব রয়েছে ওই চেঞ্জিং রূমটায়। পায়ে পায়ে আবার মলের দিকে ফিরে চললাম।
মলে ঢুকে এলিভেটরের দিকে এগোনোর সময় দেখলাম, গরম কাপড় পরে ভালুক সেজে যাওয়া একটা ছেলে দোকানের বিজ্ঞাপন করছে। হাতে একগাদা কাগজ। আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিতে গিয়ে থমকে গেল। কুঁচকে গেল ভুরু। ভাবল বোধহয়, আমি তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আজব পোশাক পরে তার জায়গা দখল করতে এসেছি।
ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলাম না। তার হাত থেকে ছোঁ মেরে একটা কাগজ কেড়ে নিয়ে, একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে সরে এলাম।
এলিভেটরে উঠলাম। আমি একা। দরজা বন্ধ হতে শুরু করল। ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, এখনও একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।
কাগজটার পেছনে পেন্সিলে লেখা রয়েছে কি যেন। দাগ পড়ে গেছে। উল্টে দেখলাম, একটা ফোন নম্বর। ছেলেটারই হবে হয়তো।
দরজাটা পুরো লেগে যাবার পর মাথার ওপরের গুঞ্জনটা কানে এল। আলো মিটমিট করতে লাগল এলিভেটরের। নিভে গেল।
বিদ্যুৎ চলে গেল নাকি! ঘাবড়ে গিয়ে অ্যালার্ম বেলের বোতামটা টিপতে যাব, ফিরে এল আলো। মুহূর্ত পরেই দরজা খুলে গেল। তিনতলার মেঝেতে পা রাখলাম আমি।
বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকালাম।
আবার সেই পরিচিত দৃশ্য। আমার পরিচিত পরিবেশ।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
শিওর, আমি অতীতে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি বর্তমানে। সত্যি কি এসেছি? দোকানটাতে গেলেই বুঝতে পারব।
করিডর ধরে প্রায় দৌড়ে চললাম পোশাকের দোকানটার দিকে। ব্লাউজটা যেখানে ছিল। কিন্তু দুই কদমও এগোতে পারলাম না। সামনে এসে দাঁড়াল দুজন গার্ড।
এই মেয়েটাই, বলল একজন।
খপ করে আমার হাত চেপে ধরে টান দিল দ্বিতীয় গার্ড, এসো আমার সঙ্গে।
কোথায়? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গেলেই টের পাবে, খুকী!
খুকী খুকী করছেন কেন আমাকে। রেগে উঠলাম। আমার বয়েস কি খুব কম মনে হচ্ছে?
কথার জবাব দিল না ওরা। একজন ওয়াকিটকি বের করে কারও উদ্দেশ্যে কথা বলল, পেয়েছি ওকে। ধরে নিয়ে আসছি…
*
রবিন এ পর্যন্ত আসতেই বাধা দিয়ে মুসা বলে উঠল, দেখো, ভাই, আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে! গলা শুকিয়ে গেছে! কোক টোক কিছু যদি থাকে, এনে দাও জলদি! খেলে হয়তো সহ্য করতে পারব।…বাপরে বাপ, কি কাণ্ড!
হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতই ঘটনা! বিড়বিড় করল জিনা।
আমি কিন্তু অবাক হচ্ছি না, ডায়েরীটা খোলা অবস্থায়ই সোফায় উপুড় করে রাখল রবিন। সেদিন লেকের পাড়ে ইউ এফ ওটা দেখার পর থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কোন কথাই আর অবিশ্বাস করব না। চোখের সামনেই তো তুলে নিয়ে গেল ওরা কিশোরকে।
উঠে রান্নাঘরে চলে গেল রবিন। আভন থেকে বের করা গরম বার্গার, আর ফ্রিজ থেকে কোক নিয়ে ফিরে এল। সামনের টেবিলে। রেখে মুসার দিকে তাকাল, খাও।
একটা বার্গার তুলে নিল জিনা। গেলাসে কোক ঢালল।
ডায়েরীতে কি লেখা আছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে ওরা। তাড়াতাড়ি গপগপ করে গিলে নিয়ে খাওয়া শেষ করল।
ডায়েরীটা আবার তুলে নিল রবিন।
মুসার দিকে তাকাল জিনা। পড়ার সময় আর বাধা দেবে না, বুঝলে! তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে না পারলে রিটার সঙ্গে আলোচনায়ও বসা যাবে না। যত জলদি সম্ভব, খুঁজে বের করতে হবে কিশোরকে।
কিন্তু কোথায় আছে কিশোর? মুসার প্রশ্ন।
কাচু-পিকচুতে। জানা থাকলে, জবাব দিতে পারত জিনা।
.
০২.
ভারী লাগামটা খচ্চরের পিঠের ওপর দিয়ে টেনে এনে শপাং করে বাড়ি মারল কিশোর।
হাঁট, শয়তান কোথাকার! রাগে চিৎকার করে উঠল সে। লাঙলের হাতল ধরে ঠেলা দিল জোরে। মাথা ঘুরিয়ে খচ্চরটাকে চোখে চোখে তাকাতে দেখে রাগ আরও বেড়ে গেল।
হাঁট! টান দে! আরও জোরে খচ্চরের পিঠে বাড়ি মারল সে।
আস্তে এক পা বাড়াল জানোয়ারটা। তারপর আরেক পা।
পিছে পিছে হাঁটতে থাকল কিশোর। লাঙল ঠেলতে ঠেলতে ব্যথা হয়ে গেছে হাত। কাধ পোড়াচ্ছে চড়া রোদ। সকালটা অর্ধেক শেষ। সূর্যোদয় থেকে পরিশ্রম করে এতক্ষণে মাত্র দুটো ফালি চাষ দিতে পেরেছে।
এ ভাবে চললে খামারটা খোয়াতে হবে। ভাবনাটা শঙ্কা জাগাল মনে। এই খামারে জন্মায়নি সে। বাপ-দাদা চোদ্দ পুরুষে। কখনও হালচাষ করেনি। কিন্তু তাকে করতে হচ্ছে, পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে।
পিঠ বেয়ে দরদর করে নামছে ঘাম। শার্টের হাতা দিয়ে ভুরুর ঘাম মুছল। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি বা লেমোনেড পেলে খখসে। গলাটা ভেজানো যেত।
কিন্তু থামার সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে। খেতের শেষ প্রান্তের দিকে তাকাল। ভুলে থাকতে চাইল পানির কথা।
থেমে গেল আবার খচ্চরটা। টানতে চাইছে না আর। থুতনি। বুকের কাছে নেমে এল কিশোরের। জানোয়ারটাকে সামলাতে গিয়ে পরিশ্রম যা হচ্ছে, তার চেয়ে নিজে টানলেও বোধহয় কষ্ট কম হত।
মাথার দোমড়ানো বাদামী হ্যাটটা খুলে নিয়ে রাগ করে মাটিতে আছড়ে ফেলল সে। গরম বাতাসে উড়িয়ে এনে মুখের ওপর ফেলতে লাগল বহুদিনের না কাটা লম্বা, কোকড়া চুলগুলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত পেছনে এনে কোমরে চাপ দিল। আগুনের মত পুড়িয়ে দিল যেন তীব্র ব্যথা। যতই দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে আরও। ফোঁস করে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, মিস্টার হার্ট, খচ্চরটাকে একটু হটতে বলুন, প্লীজ!…আপনি বললেই ও হাঁটবে। আপনার কথা শোনে। আমাকে পাত্তাই দেয় না।