না।
সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ছাতের আলোগুলোর দিকে তাকাল সে। এখনও উজ্জ্বল। মিটমিট শুরু হওয়ার আগেই যা করার করে ফেলতে হবে।
হু। …যাকগে, কি জন্যে কিনবে সেটা তোমার ব্যাপার।…পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লোকটা।
মাথা ঝাঁকাল রিটা। র্যাক থেকে তুলে নিল আলট্রা সোকারটা। একটা শপিং ব্যাগ চেয়ে নিয়ে আরও কতগুলো খেলনা র্যাক থেকে নামিয়ে দ্রুত ভরে ফেলল।
এগুলোর দাম… বলতে গেল ম্যানেজার।
দরজার দিকে রওনা হয়ে গেছে রিটা। ভেতরে থাকলে আটকা। পড়তে হবে।
চিৎকার করে উঠল ম্যানেজার, আরে আরে, কোথায় যাচ্ছ…
কথা শেষ হলো না। মিটমিট করতে লাগল বাতিগুলো। সেই সঙ্গে গুঞ্জন।
দপ করে নিভে গেল বাতি।
১৮.
ভিন্ন আরেক নাটক চলছে তখন কাচু-পিকচুতে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল কিশোর। শরীরের প্রতিটি পেশিতে ব্যথা। কাপড় খুলতেও ইচ্ছে করল না তার।
এত ক্লান্তির পরেও ঘুম এল না। যতবার চোখ বোজে, গলাকাটা গরুটার চেহারা ফুটে ওঠে তার কল্পনায়। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল গরুর চেহারা, তার জায়গা দখল করল সিসির মুখ।
সিসিকে কেন সন্দেহ করছে ওরা? জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে ভাল আচরণ করে সে, ওগুলোও তাকে পছন্দ করে, তার কথায় সাড়া দেয়। এর মধ্যে অশুভ ক্ষমতাটা কোথায় দেখতে পেল লোকে?
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। ঘোড়ার খুরের শব্দ।
গায়ের ওপর থেকে চাদরটা টান মেরে সরিয়ে ফেলে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বুকের মধ্যে কাপুনিটা বেড়ে গেছে। জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল।
চোখে পড়ল দলটাকে। দম আটকে আসতে চাইল।
সামনের আঙিনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। কতজন? পাঁচ…দশবারো? নাকি আরও বেশি?
রাতের অন্ধকারে ছায়ার মত নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
কি চায়? শেষ পর্যন্ত হুমকিটা কার্যকর করতেই কি চলে এল?
সিসিকে খুন করতে?
পেছনের কাঠের মেঝেতে শব্দ হতে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে হেনরি আর সিসি। তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আতঙ্কিত।
ওরা এসে গেছে, তাই না? কাঁপা ফিসফিসে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সিসি।
জোরে একবার মাথা ঝাঁকি দিল কিশোর, হ্যাঁ।
পাশে এসে দাঁড়াল দুই ভাই-বোন। একসঙ্গে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকাল সবাই। ঘোড়াগুলোর ঘোরাঘুরি বন্ধ হয়েছে। লম্বা সারি দিয়ে দাঁড় করিয়েছে তাদের সওয়ারিরা।
আজ আরও অনেকগুলো গরুকে মেরে ফেলতে হয়েছে, চিৎকার করে বলল একজন।
এর জন্যে দায়ী হচ্ছে ওই ডাইনী মেয়েটা, জন ফ্রেঞ্চ বলল। ওর স্লিঙে ঝোলানো হাতটাকে লাগছে সাদা তেকোনা নিশানের। মত। ওকে নামিয়ে দাও। বাকি দুজনকে কিছু করব না।
কিশোরের গা ঘেঁষে এল সিসি। ওর গায়ের কাপুনি টের পাচ্ছে কিশোর। কাঁধে একটা হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। তার অন্য হাতটা আঁকড়ে ধরল আতঙ্কিত হেনরি।
আপনাদের গরুগুলো মারা যাচ্ছে, এ জন্যে সত্যি দুঃখিত আমরা, জবাব দিল কিশোর। এতে সিসির কোন হাত নেই। দয়া করে চলে যান আপনারা। আমাদের একা থাকতে দিন।
সব শয়তানির মূলে ওই ডাইনী মেয়েটা, মার্ক ফ্রেঞ্চ বলল। নেকড়ে আর সাপ নিয়ে কি করেছে, সব শুনেছি আমরা। আমাদের সবারই গরু মরছে, তোমাদের একটাও মরে না কেন? … .তুমি বাইরের লোক, কিশোর পাশা, তোমার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। মেয়েটাকে পাঠিয়ে দাও এখানে, তোমার কিছু করব না আমরা।
জলদি বের করে দাও শয়তানীটাকে! বলল আরেকজন।
জীবনেও না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। আমার প্রাণ থাকতে নয়!
বেশ, মরো তাহলে, জন ফ্রেঞ্চ বলল। তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, কিশোর পাশা, নাওনি…
একটা মশাল জ্বলে উঠল। পটাপট জ্বলে উঠল আরও কয়েকটা। মশাল হাতে ঘোড়ায় চেপে বাড়ির চারপাশে চক্কর। দিতে শুরু করল লোকগুলো।
লাগিয়ে দাও! দেখছ কি? মার্কের চিৎকার শোনা গেল। পুড়িয়ে মারো ডাইনীটাকে!
বাড়ির দিকে একজনকে মশাল ছুঁড়ে দিতে দেখল কিশোর।
ওপরের বারান্দার একপ্রান্তে এসে পড়ল মশালটা। কিশোরের জানালার সামনে নেচে উঠল আগুন।
চিৎকার করে উঠল সিসি।
জলদি! বলল কিশোর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের! জানালার কাছ থেকে ঠেলা দিয়ে সিসিকে সরিয়ে দিল সে।
হেনরিকে পিঠে তুলে নিয়ে সিসির পিছু পিছু এসে ঢুকল হলওয়েতে। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙছে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে মশাল ছুঁড়ে মারছে লোকগুলো। গুলির শব্দ হলো।
সিঁড়ি দিয়ে ধোঁয়া উঠে আসছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। থমকে দাঁড়াল। সিসি। পেছন থেকে তাকে ঠেলা দিল কিশোর। থামলে কেন? আর কোন পথ নেই!
এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল সিসি। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেলল তাকে কিশোর। কিশোরের গলা পেঁচিয়ে ধরে পিঠের ওপর ঝুলছে হেনরি।
বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে কিশোরের ফুসফুস। ধোয়া ঢুকে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। কালো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে কাশতে কাশতে নেমে চলল সিঁড়ি বেয়ে। এলোমেলো পা ফেলছে সে-ও। হেনরির হাতটা ঢিল করার চেষ্টা করল। বরং শক্ত হলো সেটা আরও। ধোয়া থেকে বাঁচার জন্যে মুখ চেপে ধরল। কিশোরের কাঁধে। সমানে কাশছে।
মরতেই হবে বোধহয় আজ, ভাবছে কিশোর। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র সে নয়।
পৌঁছে গেল নিচতলায়। ঘুরছে, পাক খাচ্ছে আগুনের শিখা; ধারাল নখর বের করে থাবা মারছে যেন কাঠের দেয়ালের গায়ে। মাথার মধ্যে দপদপ করছে কিশোরের। ভয়াবহ উত্তাপ ওকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে।