জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রিটা। দৌড়ে ঢুকে পড়ল আবার বনের মধ্যে।
ডেরিয়ালের বেড়া ডিঙানোর শব্দ কানে এল। ছুটে আসছে দ্রুত।
নাহ, পালানো সম্ভব না। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল রিটা। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। সামান্য ঘুরে কিছুটা সরে গিয়ে ফিরে চলল বেড়ার দিকে।
আবার বেড়া ডিঙিয়ে অন্যপাশে চলে এল। না দৌড়ে আর, দাঁড়িয়ে রইল।
দেখতে পেল ডেরিয়ালকে। ছুটে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো ডেরিয়াল। থামল না। এ পাশে আসার জন্যে তরতর করে বেড়া বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
গাড়ির ব্যাটারি থেকে সংগ্রহ করা অবশিষ্ট শক্তিটুকু বেড়ার ওপর প্রয়োগ করল রিটা। মুহূর্তে গোলাপী আলোর ফুলঝুরি শুরু হলো। সেই সঙ্গে আকাবাকা রঙিন আলোর সরু সরু বিদ্যুতের সাপ নাচানাচি শুরু করল বেড়ার গায়ে। হাই ভোল্টেজের ভয়ানক বৈদ্যুতিক শক হজম করতে পারল না ডেরিয়াল। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। যে ভাবে পড়ল, সেভাবেই রইল, নড়ল না আর।
মরল কি বাঁচল, দেখারও সময় নেই রিটার। শত্রুকে কাবু করে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটতে শুরু করল।
১৬.
মলে এসে যখন পৌঁছল সে, সারা গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। দাঁড়াতে পারছে না। পরিশ্রমে থরথর করে কাঁপছে শরীর। খাবার দরকার? না, খিদে তো বোধ করছে না। বুঝল, কি জিনিস দরকার তার।
ব্যাটারি! রিচার্জ করতে হবে দেহটাকে। ব্যাটারিশূন্য হয়ে গেছে একেবারে।
পথে একটা বুঁদ থেকে রবিনদের মলে আসতে ফোন করে দিয়েছে। এখানে লোকের ভিড়ে ডেরিয়াল বা তার দলের লোকেরা এসে আঘাত হানতে সাহস করবে না। নিরাপদে কথা বলা যাবে।
টলতে টলতে মলে ঢোকার গেটের দিকে এগোল রিটা। দিগন্তরেখার দিকে ঝুঁকে পড়েছে সূর্য। পার্কিং লটে বিরাট লম্বা ছায়া পড়েছে রিটার।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে। কতক্ষণ ধরে দৌড়েছে সে? অনন্তকাল!
একটা খেলনা ঘোড়ার ওপর বসে কাঁদছে তিন বছরের একটা বাচ্চা। সারা মুখ আইসক্রীমে মাখামাখি। আরও আইসক্রীমের জন্যে কাঁদছে বোধহয়। ওকে ঘোড়ায় বসিয়ে নিশ্চয় কোন কিছু কিনতে গেছে মা। রিটার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল বাচ্চাটা।
কারণটা বুঝতে সময় লাগল না রিটার। খাড়া খাড়া হয়ে গেছে চুল। কাপড় ঘেঁড়া। কাদায় মাখামাখি সারা গা। হরর ছবির ভূত। নিশ্চয় বাচ্চাটা তাকে ভূতই মনে করেছে।
কেয়ার করল না রিটা। মলের দিকে এগোল। কিন্তু পা তুলতে পারছে না আর। খেলনা ঘোড়ার কয়েন বক্সটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
মুহূর্তে শক্তি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল শরীরে। ছলকে উঠল রক্তস্রোত। চুলগুলো স্বাভাবিক হয়ে এল।
কয়েকবার জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে আচমকা থেমে গেল ঘোড়াটা। ডেড। মেশিনের ব্যাটারি আবার রিচার্জ না করলে আর চলবে না।
ঘোড়া থামতেই আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
হাঁটতে শুরু করল রিটা। মলে ঢুকল।
দেখল, ওর আগেই এসে বসে আছে রবিন। ভিডিও গেমের দোকানের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। রিটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। হাঁ করে তাকিয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর এগিয়ে এল।
জিনা আর মুসা, কোথায়? জানতে চাইল রিটা।
দোকানের ভেতর।
গেম খেলছে?
না। সবাই একসঙ্গে থাকিনি, নিরাপত্তার জন্যে। কে কোন্খান থেকে নজর রেখেছে বলা মুশকিল। বুঝতে পারছি শত্রুর চোখ রয়েছে আমাদের ওপর। তাই ছড়িয়ে-ছিটয়ে রয়েছি। আমি তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। রিটার ওপর নজর বোলাল রবিন। কিন্তু তোমার অবস্থা তো শোচনীয়। কি হয়েছিল?
আগে বাথরূম থেকে আসি। লোকে কিভাবে তাকাচ্ছে দেখছ না? কাদামাটিগুলো ধুয়ে আসি।
দাঁড়াও, আমরাও আসি তোমার সঙ্গে। জিনা আর মুসাকে ডাকতে ভেতরে ঢুকে গেল রবিন।
ওরা তিনজন বেরিয়ে আসার পর পরই একটা অদ্ভুত ঘটনা। ঘটল। মিটমিট করে উঠল মলের সমস্ত আলো।
খাইছে! অবাক হয়ে রিটার দিকে তাকাল মুসা। তুমি করছ?
নীরবে মাথা নাড়ল রিটা। সে-ও অবাক।
একসঙ্গে নিভে গেল সমস্ত আলো। যে ভাবে নিভল, তাতে মনে হয় মেইন লাইন জ্বলে গেছে। কোথায় খারাপ হয়েছে, সেটা বের করে, সারিয়ে-সুরিয়ে আবার আলো জ্বালতে প্রচুর সময় লাগবে। বাইরে সূর্যও ডুবতে বসেছে। গোলাপী-কমলা আলোর খেলা ম্লান করে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে নীলচে-ধূসর গোধূলি।
বাতি নিভে যাওয়ায় মল জুড়ে শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। লুটপাটের ভয়ে তাড়াতাড়ি শাটার নামিয়ে দিতে শুরু করল দোকানদাররা। করিডরে ছোটাছুটি করছে লোকে। হলে উদ্বিগ্ন। ক্রেতার ভিড়। কি হয়েছে জানতে চাইছে সবাই।
কালো পোশাক পরা চারজন গার্ডের আবির্ভাব ঘটল এ সময়। কালো সানগ্লাস, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো বেজবল ক্যাপ নিয়ে অন্ধকারে চমৎকার ভাবে মিশে যাওয়ার সুযোগ হলো।
ওদের। তবে হাতে টর্চ আছে চারজনেরই।
এদিক দিয়ে আসুন, প্লীজ, টর্চের আলো নেড়ে উত্তেজিত ক্রেতাদের পথ দেখাল একজন। ঘাবড়াবেন না। আসুন।
দ্রুত সাড়া দিল লোকে। পথ দেখিয়ে সবাইকে গেটের দিকে নিয়ে চলল গার্ডেরা।
সারির পেছনে রইল চার গোয়েন্দা।
গার্ডগুলোকে সন্দেহ হচ্ছে আমার, নিচুস্বরে রবিন বলল। দেখছ, কেমন টর্চের আলো ফেলছে সবার মুখে? কাউকে খুঁজছে ওরা।
আমাদের! রিটার কণ্ঠে শঙ্কা।
তাই তো! জিনা বলল। দেখো, চোখ থেকে সানগ্লাস খুলছে না ওরা। তারমানে চোখ দেখলেই চমকে যাবে লোকে। বনের মধ্যে সে-রাতে নকল কিশোরের চোখ কি রকম ছিল মনে আছে?