সর্বনাশ! খবরটা শুনে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেল মা। আমার চোখের দিকে তাকাতে পারল না।
কি মা, কি হয়েছে? জানতে চাইলাম।
তারমানে ওরা জেনে গেছে, মা বলল। এবং তারমানে তোকেও ধ্বংস করতে কিংবা ধরে নিয়ে যেতে আসবে ওরা। সাবধান, রিটা, মা কতটা সিরিয়াস, আমাকে রিটা বলে ডাকাটাই তার প্রমাণ, খুব সাবধান! তোকে বাঁচানোর জন্যে আমি ওখানে থাকতে পারব না। নিজেকে বাঁচাতে হবে তোর নিজেরই।
কি বলছ, মা? কার হাত থেকে বাঁচাব?
সময় নেই, যা বললাম মনে রাখিস। আরেকটা কথা, কোন কথা জানতে হলে মাদাম জিৎসুর সঙ্গে যোগাযোগ করিস। ওই মহিলা অনেক জ্ঞানী, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অনেক খবর রাখে…
তুমি ওই জিপসি গণক মহিলার কথা বলছ? ও তো একটা চীট…
গুড-বাই, রিটু!
মা, মা যেও না! আরেকটু দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠলাম।
কি, বল।
আমার মনে হলো, মাকে যদি এখন বলে দিই, কিভাবে মারা গেছে সে, তাহলে হয়তো আর মারা যাবে না। ভয়াবহ সেই সকালটা এড়াতে পারবে। যদি পারে, নিয়তি বদলে যাবে তার। মারা আর যাবে না।
কিন্তু কোন ভাবেই কি নিয়তি বদলাতে পারে মানুষ? অতীতকে পরিবর্তন করে ভবিতব্য এড়াতে পারে?
চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? মাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে বললাম, মা, শোনো, খুব জরুরী একটা কথা বলি তোমাকে।
কি, মণি?
জুলাইয়ের পাঁচ তারিখে তোমার অফিসে আগুন লাগবে…
তাড়াতাড়ি আমার মুখে হাত চাপা দিল মা, কথা বলতে দিল না। না না, আমি শুনতে চাই না, কেঁপে উঠল তার গলা। আমার অনেক কাজ, রিটা; আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।
আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও, মা, ককিয়ে উঠলাম। তোমাকে ছাড়া আমার আর দিন কাটে না। তুমি যেখানেই যাও, সেটা যদি পরকালও হয়, নিয়ে যাও আমাকে।
না, মণি, তা হয় না। তোর এখানে অনেক কাজ বাকি। ছবির বাকি ছেলেমেয়েগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে তোকে। ডানার মত ওদেরকেও যদি ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে, উদ্ধার করে। আনতে হবে। যে অসামান্য ক্ষমতা রয়েছে তোর, প্রয়োজনে সেটা প্রয়োগ করবি। বুদ্ধি করে চললে ওরা যত শক্তিশালীই হোক, তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বেঁচে যেতে পারবি।
কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না। তুমি নেই, আমার দিনগুলো বড় কষ্টে কাটে…
কে বলল নেই? হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল মা। তার কাঁধে মুখ লুকালাম। আমার অনেক কিছু তোর মধ্যে ভরে দিয়েছি। তোর মনের ক্ষমতা প্রয়োগ করবি। নিজের ভেতরের আয়নার দিকে তাকাবি। দেখতে পাবি আমাকে।
আমাকে ছেড়ে দিল মা। চোখ মেলোম না। তার পারফিউমের গন্ধ নাকে আসছে আমার। হয়তো শেষবারের জন্যে।
অবশেষে কেটে গেল ঘোর। চোখ মেলে দেখলাম, মা নেই ঘরে।
দরজার বাইরে পদশব্দ। ভাবলাম, মা চলে যাচ্ছে ওদিক দিয়ে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে বেরোলাম।
মা নয়, বাবাকে আসতে দেখলাম। আমাকে উত্তেজিত দেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, রিটা?
আঁ!…না, কিছু না!
গালে পানি কেন তোর? কেঁদেছিস?
না, কই? কাঁদিনি তো।
কেঁদেছিস। নিশ্চয় মার জন্যে মন খারাপ লাগছিল।…যাই, বলে দিই ওকে, তোর শরীর ভাল নেই, এখন আর দেখা হবে না।
কাকে, বাবা?
আরে ওই পুলিশ অফিসারটা। ডেরিয়াল। এসে বসে আছে, তোর সঙ্গে নাকি কি জরুরী কথা আছে।
এই এক বিরক্তি! সেদিনের পর থেকে, অর্থাৎ বনের মধ্যের সেই ঘটনাটার পর থেকে মাঝে মাঝেই এসে আমার সঙ্গে দেখা করে লোকটা। ইনিয়ে-বিনিয়ে একটা কথাই জানতে চায়: কি ভাবে ছেলেগুলোকে কাবু করলাম আমি?
বাবাকে বললাম, যাও, শরীর খারাপই বলে দাও। এখন দেখা করতে পারব না আমি।
*
শেষ হলো রিটার ডায়েরী। মুখ তুলে তাকাল রবিন। তার পড়া শেষ হবার পরেও দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না।
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল জিনা। চলো।
কোথায়? অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল মুসা।
রিটাদের বাড়িতে। এখন!
হ্যাঁ, অসুবিধে কি? ডায়েরীটাও ফেরত দেব আর কিশোরের ব্যাপারে কি করা যায়, সেটাও আলোচনা করব।
তারমানে, রবিন বলল, তুমি বিশ্বাস করেছ রিটার কথা?
নিজের ডায়েরীতে কেউ মিছে কথা লেখে না। তা ছাড়া কত রকমের উদ্ভট ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে, তার হিসেব রাখে কে? চোখের সামনে যা যা দেখতে পাই আমরা, সে-সব ছাড়াও আরও বহু কিছু আছে–ব্যাখ্যার অতীত, যেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে পাগল হয়ে যাওয়া লাগবে।
বাপরে! হেসে বলল রবিন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, একেবারে কিশোরের মত লেকচার শুরু করে দিলে। ডায়েরীটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। চলো। যাই।
.
১৫.
বেডরুমের দরজায় টোকা শুনে উঠে গেল রিটা। খুলে দিল।
বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। রিটা, অফিসার ডেরিয়াল তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রান্নাঘরে বসিয়ে রেখে এসেছি। কফি খাচ্ছে।
কেন?
কি জানি, কি একটা ফর্ম নাকি পূরণ করতে হবে বলল। ওই যে সেদিন, বনের মধ্যে গোলমালটা করল-ছেলেগুলোকে নাকি কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে। তোর ফর্মটা কোর্টে দাখিল করতে হবে।
ঠোঁট কামড়াল রিটা। কি যেন ভাবল। বেশ, যাও, আমি আসছি। কাপড়টা বদলে আসি।
মিস্টার গোল্ডবার্গ চলে গেলেন।
সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার অপেক্ষা করল রিটা। তারপর দৌড়ে এসে ঢুকল দোতলার হলরুমে, টেলিফোনটা যেখানে। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ডায়াল করল রবিনদের বাড়ির নম্বরে।