হ্যাঁ, উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। আমাদের গাড়িটা আচমকা মাঝরাস্তায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঘড়িটা গেল ডেড হয়ে। সিডি প্লেয়ার চলল। বাতিগুলোর কাছাকাছি গেলেই মিটমিট শুরু করে।
হুঁ, তারমানে আঁচ করে ফেলেছিস নিজের ভেতরের ক্ষমতার কথা, মা বলল। ওসব যন্ত্র থেকে সমস্ত বিদ্যুৎ শুষে নিয়ে নিজের ভেতরে জমা করে ফেলেছিলি নিজের অজান্তে। সেজন্যেই ডেড হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রগুলো।
বলো কি! আমি তাহলে বান মাছের মত মানুষকে বৈদ্যুতিক শক দিতে পারি?
হাসিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল মায়ের চোখ। বান মাছের চেয়ে অনেক বেশি পারিস। তবে কাউকে যাতে অহেতুক শক না দিয়ে বসিস, সে-জন্যে এটার ব্যবহার শিখতে হবে তোকে। নিয়ন্ত্রণ করা জানতে হবে। তা না হলে কখন যে কাকে খুন করে ফেলবি, ঠিক, নেই।
আমার হাত নিজের হাতে তুলে নিল মা। তবে ভয় নেই, নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে সময় লাগবে না। এটা তোর একটা বাড়তি ক্ষমতা। আসল ক্ষমতাটা জাম্পিং। তুই একজন জাম্পার।
আমি কি?
জাম্পার। আমাদের বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স, নিজের মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চয় করে তার মধ্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলতে পারিস তুই। সেই সুড়ঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চলে যেতে পারিস যে কোন সময়ে-যাকে মোটামুটি ভাবে বলা হয়ে থাকে টাইম ট্র্যাভেল বা সময়-ভ্রমণ।
ওভাবেই আমাকে এই উনিশশো সাতাশি সালে নিয়ে এসেছ নাকি? মায়ের কথা হাঁ করিয়ে দিয়েছে আমাকে।
মুচকি হাসল মা। আমি আনিনি। আমি জাম্পার নই। তুইই এসেছিস আমার কাছে। নিজেই নিজেকে নিয়ে এসেছিস।
কিন্তু কিভাবে? আমি তো চেষ্টাও করিনি।
চেষ্টা তোকে করতে হয়ও না। তোর অতি-ইন্দ্রিয়ই এ ব্যাপারে তোকে সাহায্য করে।
বুঝলাম না।
আচ্ছা, বল্ তো, কখন উড়তে শেখে পাখির ছানা? ওড়ার জন্যে তাকে কি কোন শিক্ষা নিতে হয়?
না, জবাব দিলাম।
তারমানে উড়তে পারার ক্ষমতাটা ওর জন্মগত। ডিমের ভেতর থেকে যেদিন বেরোয় সেদিন থেকে ক্ষমতাটা তৈরি হয়ে যায় ওর মধ্যে। কিন্তু পারে না যতক্ষণ না মা ওকে বাসা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়।
মার কথা ভয় ধরিয়ে দিতে লাগল আমার। তুমি কি বলতে চাইছ আমি উড়তেও পারি?
না, তা পারিস না। একটা উদাহরণ দিলাম। বাসা থেকে ঠেলে ফেলার পর হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে ফেলে পাখির ছানা, সে উড়তে পারে। কিছুক্ষণ আনাড়ির মত ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে শেষে ঠিক শিখে ফেলে কি করে ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সময়মত আমিও তোকে কেবল একটা ঠেলা দিয়ে দিয়েছি। বাকিটা তোর আপনা-আপনিই হয়ে যাবে।
কিন্তু, মহা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম, তুমি আমাকে ঠেলা দিলে কিভাবে? তুমি তো আমার সঙ্গেই ছিলে না।
ছিলাম, মাথা ঝাঁকাল মা। তুই সেটা বুঝতে পারিসনি। বহুকাল আগে তোর মগজে একটা মেসেজ রেখে দিয়েছিলাম আমি। তোর এবারকার জন্মদিনে যাতে আমার কাছে আসতে পারিস, পিছিয়ে আসতে পারিস এখনকার সময়ে। মেসেজটাকে উস্কে দেয়ার জন্যে আরও একটা জিনিসের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম, যেটা দেখলেই মনের মধ্যে ঝড় ওঠে তোর…
ব্লাউজটা! জোরে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছি, যেন চিত্তার করলেই এই মধুর স্বপ্নটা টুটে যাবে, অদৃশ্য হয়ে যাবে মা।
বুঝতে পারছি এখন, দোকানে ব্লাউজটা দেখে চেনা চেনা লেগেছিল কেন।
হ্যাঁ, মা বলল, ওটা এক ধরনের ভিজিউল ট্রিগার। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই জাম্প করতে পারবি। কিন্তু আপতত ট্রিগারটা অন করার জন্যে সামনে একটা কিছু থাকা দরকার। ব্লাউজটা দিয়েই প্রোগ্রাম সেট করে রাখতে হয়েছিল আমাকে। ঘড়ি দেখল মা। আর বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।
এই কথাটা শোনার ভয়ই করছিলাম। আবার হারাতে যাচ্ছি। মাকে। কেন? যাবে কেন?
মা যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। একটা কথা মনে রাখবি, সময়-ভ্রমণ একটা ভয়ানক ব্যাপার। এতে স্পেস-টাইম কনটিনামে চিড় ধরায়। অতীতের সামান্যতম পরিবর্তনও ভয়ঙ্কর সময়-কম্পন সৃষ্টি করতে পারে…
চোখ বন্ধ করল মা। মাথা ঝেড়ে অতীতের কোন স্মৃতি যেন ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইল। ব্যাপারটা বড়ই জটিল, রিটু। এখানে যত কম সময় কাটাবি তুই, ততই ভাল। সেজন্যে মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যে তোকে এখানে নিয়ে এসেছি আমি।
পনেরো মিনিট! মাত্র! কিন্তু আমার তো আরও অনেকক্ষণ থাকার ইচ্ছে।
আমার হাতে মার হাতের চাপ শক্ত হলো। চাইলেই তো আর সব হয় না। কথা বাড়াসনে। জরুরী কথা সারতে হবে। তোকে এখানে ডেকে আনার সেটাও একটা কারণ। একটা খাম থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করল। ছয় থেকে সাত বছর বয়সের পাঁচটা হাসিখুশি ছেলেমেয়ের গ্রুপ ছবি। নে, এগুলো দেখ। দেখে বল তো, কাউকে চিনতে পারিস কিনা। এ ছবিগুলো পরিচিত লাগল আমার। বিশেষ করে একটা মেয়ের চোখ। মাথা নেড়ে বললাম, চেনা চেনাই লাগছে, তবে চিনতে পারছি না।
এদের সবার বয়েস এখন তোর সমান হয়ে গেছে, মা বলল। নাম বললে হয়তো চিনবি না। কারণ পরিচয় গোপন রাখার জন্যে আসল নামও হয়তো বদলে ফেলা হয়েছে।
ছবিটা হাতে নিয়ে আরও ভাল করে চেহারাগুলো দেখতে লাগলাম। চিনে ফেললাম একজনকে। একটা মেয়ে, যার চোখ বেশি পরিচিত লাগছিল। মেয়েটার ছবিতে আঙুল রেখে বললাম, ডানা হিউগ্রি! কিন্তু ও তো কিছুদিন আগে রহস্যময় ভাবে উধাও হয়ে গেছে। ভিনগ্রহবাসীরা ধরে নিয়ে গেছে তাকে!