এমন ভাবে চমকে গেলাম, টেবিলের নিচে আছি ভুলে গিয়ে মাথা তুলতে গিয়ে বাড়ি খেলাম টেবিলে। ব্যথা লাগল। উহ করে মাথা নিচু করে ফেললাম। এ প্লাগটা ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম বাইরে। আমি ছেড়ে দিতেই আবার পাওয়ার চলে গেছে, অফ হয়ে গেছে প্লেয়ার। বুঝতে আর অসুবিধে হলো না, আমি একটা চলমান জেনারেটরে পরিণত হয়েছি।
চোখ পড়ল আবার ব্লাউজটার ওপর। মনে হলো, গতকাল ওটা গায়ে দেয়ার পর থেকেই যত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। গায়ে। দিয়ে অতীতে চলে গিয়েছিলাম। নিজের মধ্যের ভয়ঙ্কর ক্ষমতাটা প্রকাশ পেল…
সত্যি কি তাই?
আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার কৌতূহল দমন করতে পারলাম না। নিশ্চিত হতে হবে, ওই ব্লাউজটার মধ্যেই লুকানো রয়েছে কিনা এত ক্ষমতা। জানাটা জরুরী মনে হলো আমার কাছে।
ব্লাউজটা হাতে করে নিয়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আয়নার দিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে পরে ফেললাম। ভয় লাগছে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে। কি ঘটবে জানি না।
মলের ড্রেসিং রুমে যা ঘটেছিল, ঠিক একই ভাবে মিটমিট করতে লাগল ঘরের বাতিটা। কানের কাছে গুঞ্জন শুনলাম। তারপর দপ করে বাতি নিভে গেল।
জ্বলে উঠল আবার।
ঘরের বাইরে পদশব্দ শুনতে পেলাম। বাবা আসছে নিশ্চয়। বাবা! গলা চড়িয়ে ডাক দিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। উপহারটার জন্যে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। বাবা…
দরজা খুলেই স্থির হয়ে গেলাম।
বাবা নয়!
*
পড়া থামাল রবিন। দম নিল। ডায়েরীতে কটা পাতা আর বাকি আছে উল্টে দেখল। মুখ তুলে বলল, আর বেশি নেই। মাত্র কয়েকটা পাতা।
পড়ে ফেলো, মুসা বলল। বাপরে বাপ, এ কি গল্প শোনাচ্ছে! আমার কাছে তো রীতিমত ফ্যান্টাসি মনে হচ্ছে।
মাথা ঝাঁকাল জিনা। চোখের সামনে সেদিন কিশোরকে রূপ পাল্টাতে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। ভাবতাম, রিটা গুল মারছে।
পড়ো, পড়ো! তাগাদা দিল মুসা।
লম্বা শ্বাস টেনে ফুসফুস বোঝাই করল রবিন। ধীরে ধীরে সেটা বের করে দিয়ে চোখ নামাল আবার ডায়েরীর পাতায়। রিটা লিখেছে:
এমন একজনকে দেখতে পেলাম, যাকে বহুকাল দেখি না। পরনে বড় বড় গোলাপী ফুল আঁকা কাপড়ের হাউসড্রেস। কানে ম্যাচ করা রঙের রিং। ওই পোশাক আমার অতি পরিচিত। কতবার ওটার নিচের অংশ ধরে টানাটানি করেছি। ওটা ধরে শপিং সেন্টারে গেছি, আরও কত কি।
মা! চিৎকার দিয়ে সামনে ছুটে গেলাম।
ঠোঁটে আঙুল রেখে চিৎকার করতে মানা করল মা। আমার ঘরে ঢুকে আস্তে লাগিয়ে দিল দরজাটা।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আবার সেই মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, বহু বছর আগেই যাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। জীবনে আর কোনদিন দেখতে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারছি। স্বপ্ন নয়, পুরোপুরি বাস্তব।
হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার ঘরটাও বদলে গেছে। গত গ্রীষ্মে কেনা বাঘের গায়ের ডোরাকাটা রঙের বেডশীটটা নেই বিছানায়, তার জায়গায় পাতা রয়েছে জলকুমারী আঁকা চাদর। জানালার পর্দাগুলো রঙধনু রঙের। বহু বছর আগে বাবা কিনে এনে দিয়েছিল মাকে। আমার প্রিয় গায়ক-গায়িকার পোস্টারগুলো দেয়াল থেকে উধাও। ওগুলোর জায়গায় টানানো রয়েছে কয়েকটা হাতে আঁকা ছবি। একটা বিশেষ ছবির দিকে চোখ পড়তে যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। নতুন টানানো হয়েছে। একটা শপিং সেন্টার থেকে কিনে আনা হয়েছিল, ১৯৮৭ সালে। তেরো বছর আগে আমার বেডরূমটা যে ভাবে সাজানো ছিল, সেই দৃশ্য।
আমার মাকেও সে-সময় যেমন দেখেছিলাম, তেমনি আছে। তেমনি সুন্দরী। তেমনি হাসিখুশি।
ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বহুদিন পর আবার যখন ফিরে পেয়েছি, কোনমতেই আর ছাড়ব না।
আরে, ছাড়, ছাড়! সেই আগের মত হেসে বলল মা। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। রিটুমণি, কেমন আছিস, মা?
মায়ের মুখের সেই পুরানো আদুরে ডাক শুনে সহ্য করতে পারলাম না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মায়ের জন্যে কি যে শূন্যতা জমে ছিল আমার বুকের মধ্যে। হাজারটা প্রশ্ন ছলবলিয়ে উঠে আসছে যেন আমার মুখে। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা করব? জিজ্ঞেস করলাম, আমার কি হয়েছে, মা? আমি এখানে এলাম কি করে?
আমিই প্রোগ্রাম সেট করে রেখেছি, যাতে তুই চলে আসতে পারিস এখানে, মা জবাব দিল।
প্রোগ্রাম মানে? তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমি কি ভিসিআর নাকি?
হেসে উঠল মা। অনেকটা তা-ই। ভিসিআর-এর সার্কিটে ছোট্ট কম্পিউটার চিপ থাকে, মনে করিয়ে দেয় কখন যন্ত্রটাকে অন করে রেকর্ড শুরু করতে হবে, জানিস তো?
মাথা ঝাঁকালাম।
মানুষের দেহটাকেও ভিসিআর-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। তফাৎটা শুধু তারের মাধ্যমে সঙ্কেত পাঠায় কম্পিউটার চিপ, আর মানুষের পাঠায় মগজ-খুব সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সঙ্কেত, স্নায়ুর মাধ্যমে।
তারমানে আমি যা করতে পারছি, জিজ্ঞেস করলাম, সব মানুষই তাই পারবে?–
না, মাথা নাড়ল মা, ত পারবে না। আর সব মানুষের মধ্যে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত এত দুর্বল, আছে যে সেটাই বুঝতে পারে না। তোর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। তুই যে কোন মেশিনের ব্যাটারি থেকে শক্তি সংগ্রহ করে নিজের ভেতরে সঞ্চয় করতে পারিস। একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, তোর এবারের জন্মদিনের শুরু থেকে তোর ছোঁয়ায় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিগুলো কেমন উদ্ভট আচরণ করে?