রাতের ঘটনার কথা ভাবলাম। আরেকবার ওদেরকে দেখার কৌতূহল সংবরণ করতে পারলাম না। বললাম, যাব।
*
হাসপাতালের লোডিং বে-তে পৌঁছে শব্দ শুনেই বোঝা গেল কোথায় আছে ওরা।
আমি যাব না! আমি যাব না! শুনতে পেলাম চিৎকার। পরিচিত সেই কর্কশ কণ্ঠ। নেতাটা। হাত সরাও!
তোমাকে কে কেয়ার করে, দারোয়ানের ছাও? চিৎকার করে উঠল আরেকজন। পিস্তল রেখে এসো দেখি, হয়ে যাক এক হাত, কে হারে কে জেতে! হিপোর কণ্ঠ।
এক সারি অ্যামবুলেন্সের কাছে এসে থামল আমাদের গাড়ি। বাবা, ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, অফিসার ডেরিয়াল এবং আমি-গাড়ি থেকে নামলাম। দেখতে পেলাম সেই চার যুবককে। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। ওদের ভ্যানে তোলার চেষ্টা করছে। দুজন পুলিশ। কোনমতেই ভ্যানে উঠতে চাইছে না। হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডেরা ঘিরে রেখেছে চারপাশ থেকে।
চারজনের হাতেই হাতকড়া। একজনের হাতের সঙ্গে আরেকজনকে জোড়া দিয়ে শেকল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আলাদা থাকলে দৌড় দিত। একটা বিচিত্র জিনিস লক্ষ করলাম-ওদের চুল; তারের মত খাড়া হয়ে আছে। বৈদ্যুতিক শক খেয়েছে যে, নিশ্চয় সেজন্যে।
বাহ, চুলের ছাঁট তো বেশ চমৎকার হয়েছে! বলতে বলতে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। কে ছেটে দিল? ডিজাইনার হবিস হপকিনস?
আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে নেতা-গুণ্ডা। আতঙ্ক ফুটল চোখের তারায়। ঝুলে পড়ল নিচের চোয়াল। চিল্কারের ভঙ্গিতে হাঁ হয়ে গেল মুখ। শব্দ বেরোল না।
কিন্তু হিপোর চিৎকার রুদ্ধ হলো না। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। সোজা দৌড় দিল পুলিশ ভ্যানের দিকে। বাকি তিনজনকেও টানতে টানতে নিয়ে চলল সঙ্গে। যেটাতে উঠতে বাধা দিচ্ছিল এতক্ষণ, সেই ভ্যানটাই যেন ওদের শেষ আশ্রয়স্থল।
সরাও, সরাও ওকে! মুখে কথা ফুটল লাল-চুলো নেতাটার। ও একটা আস্ত ডাইনী! দুজন পুলিশ অফিসারের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইল সে। এবার আমাদের মেরেই ফেলবে! দোহাই তোমাদের, আমাকে জেলখানাতেই নিয়ে চলো!
প্লীজ! কেঁদে ফেলল বাহাদুর হিপো। ওকে কাছে আসতে দিয়ো না!
স্তব্ধ বিস্ময়ে দৃশ্যটা তাকিয়ে দেখলেন ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, অফিসার ডেরিয়াল ও বাবা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ। একজন একজন করে চোখ ফেরাল আমার দিকে।
হ্যাঁ, এরাই, ক্যাপ্টেনকে বললাম আমি। এই শয়তানগুলোই কাল রাতে ধাওয়া করেছিল আমাকে।
.
১৪.
ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দে চোখ মেলতে বাধ্য হলাম। মনে হলো কয়েক মিনিট আগে ঘুমিয়েছি। রাগ হলো ঘড়িটার ওপর। তাকিয়ে দেখি, দুপুর পেরিয়ে গেছে। তারমানে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়েছি।
জানালার বাইরে উজ্জ্বল আলো। মনে পড়ল সব কথা। কাল রাতে ডাক্তার অলরিজকে দিয়ে আমার রিলিজ পেপার সই করিয়ে। বাড়ি নিয়ে এসেছে বাবা। ঘড়িটাতে আমিও অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। গরমের ছুটি। স্কুলে যাবার তাড়া নেই। ভাবলাম, আরেকটু ঘুমিয়ে নিই।
অ্যালার্ম বন্ধ করার জন্যে সুইচ টিপতে গেলাম। কিন্তু ঘড়িটার গায়ে আমার আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। বন্ধ হয়ে গেল ঘড়িটা। পুরোপুরি মৃত! অ্যালার্ম তো বন্ধ হলোই, সময় শো করার যে লাল নম্বরগুলো জ্বলছিল, সেগুলোও নিভে গেল মুহূর্তে।
চোখ থেকে ঘুম দূর হয়ে গেল আমার। মনে পড়ল গাড়িটার কথা। গতরাতে গাড়িটাও এই ঘড়ির মতই আচমকা মরে গিয়েছিল।
তুলে নিলাম ঘড়িটা। অদ্ভুত একটা সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতি টের পেলাম আঙুলে। হাত, বাহু বেয়ে উঠে এল শরীরে, পেটের কাছে নেমে গেল। চাঙা বোধ করতে লাগলাম। ১ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে মাটিতে নামলাম। ড্রেসারের ওপর চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম সিডি প্লেয়ারটা। পাশে রাখা সেই ব্লাউজ, যেটার কারণে এত হেনস্তা হতে হয়েছিল গতকাল।
সিডিটা নতুন। নিশ্চয় আমার জন্মদিনের উপহার। বাবা কিনে এনে রেখে দিয়েছে, আমি যখন ঘুমিয়েছিলাম।
খুব খুশি হলাম। বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল মনটা। এত ভাল বাবা খুব কম মেয়েরই ভাগ্যে জোটে।
এ রকম একটা সিডি প্লেয়ার পাওয়ার আমার বহুকালের শখ। বাজাতে গেলাম। ড্রেসারের নিচে কার্পেটের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে বাক্সটা। ওতে একটা পাতলা বই পেলাম। কি করে বাজাতে হয়, লেখা রয়েছে তাতে।
সিডি প্লেয়ার বাজাতে জানি আমি। তা-ও বইটা দেখে নিলাম ভালমত। সিডির পেছনের তার-সহ প্লাগটা বের করে নিলাম। সকেটে ঢোকাতে হবে। সকেটটা রয়েছে মার পড়ার টেবিলের নিচে। চেয়ার সরিয়ে ঢুকে পড়লাম টেবিলের নিচে। প্লাগের কাঁটাগুলো ঢোকাতে গেলাম সকেটে। ঢুকল না।
কয়েকবার চেষ্টা করে কেন ঢুকছে না দেখার জন্যে তুলে আনলাম চোখের সামনে। একটা কাটা সামান্য বাঁকা হয়ে আছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। নতুন জিনিসটার বাকা কাঁটা! সোজা করতে প্লায়ার্স লাগবে। বেরিয়ে আসার আগে প্লায়ার্স ছাড়াই সোজা করা যায় কিনা দেখার জন্যে দুই আঙুলে টিপে ধরে চাপ। দিলাম। বাকি আঙুলগুলোর কোন একটা বোধহয় অন্য কাঁটাটাতে লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল এক আজব ঘটনা। জ্যান্ত হয়ে উঠল সিডি প্লেয়ার। পাওয়ার পেয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়ে গেছে মেশিনে। একটা সিডি ঢোকানোই ছিল, প্লে বাটনটাও অন করা ছিল, বাজতে শুরু করল সেটা।