সাধারণত এ ধরনের বড় দোকানগুলোকে আমি এড়িয়েই চলি। কিন্তু ব্লাউজটার ওপর চোখ পড়ে গেছে আমার। সেই মে মাস থেকে উইনডোতে ঝোলানো দেখে আসছি। এটা জুন। এতদিনেও রাউজটা মাথা থেকে দূর করতে পরিনি আমি। কি করে পারব? আমার বয়েসী কোন মেয়েই পারবে না। এত সুন্দর জিনিস! কি তার রঙ: খাঁটি বিদ্যুৎ-নীল। হাতা কাটা। হাতে তৈরি লেস আর সিল্কের সুতোর অলঙ্করণ। একটা অদ্ভুত ব্যাপার-মনে হলো, আগে কোথাও দেখেছি ব্লাউজটা। ছোঁয়ার জন্যে, আপন করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম।
ক্লডিয়া বলে গেল এক সেকেন্ড, কিন্তু ফিরল পুরো পাঁচ মিনিট পর। মুখটাকে গম্ভীর করে রেখে জানাল, তোমার জন্যে একটা চেঞ্জিং রূম রেডি করতে দেরি হয়ে গেল। এসো।
রেডি করেছে মানে! অবাক হলাম। আমি তো জানতাম পোশাকের দোকানে চেঞ্জিং রূম রেডিই থাকে। ও কি আমাকে চোর ভেবেছে? গোপন ক্যামেরা চালু করে রেখে এসেছে?
*
থাবড়া মেরে দেয়া উচিত ছিল বদমাশ বেটিটার মুখে! বলে উঠল মুসা। ছেদ পড়ল রবিনের পড়ায়। ডায়েরী থেকে মুখ তুলে তাকাল।
যা-ই বলো, মাথা দুলিয়ে বলল জিনা, রিটা লেখে কিন্তু চমৎকার। ভাষা ভাল। একেবারে ছবি দেখিয়ে দেয়। প্র্যাকটিস রাখলে বড় লেখক হতে পারবে।
হুঁ মাথা ঝাঁকাল রবিন।
পড়ো, পড়ো, এরপর কি হয়েছে শোনা যাক।
আবার ডায়েরীর দিকে চোখ নামাল রবিন।
*
চেঞ্জিং রুমে ঢুকে আর একটা মুহূর্তও দেরি করলাম না। ক্যামেরার কথা মাথা থেকে উধাও করে দিয়ে পরে ফেললাম। ব্লাউজটা। এমন ভাবে ফিট করল, যেন আমার জন্যেই মাপ দিয়ে বানানো হয়েছে।
আয়নার দিকে তাকালাম। সত্যি, দারুণ মানিয়েছে আমাকে। তবে দামটা অতিরিক্ত। তিনশো ডলার। একটা ব্লাউজের দাম তিনশো, কল্পনা করা যায়! বাবার পকেট থেকে এতগুলো টাকা খসাতে মায়াই লাগল আমার। কিন্তু কোনমতেই লোভ ছাড়তে পারলাম না। আয়নার দিক থেকেও চোখ সরাতে পারলাম না।
একদৃষ্টিতে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন কি ঘটে যেতে লাগল আমার ভেতরে। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। সাংঘাতিক ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে যেন আমার মধ্যে। ব্লাউজটা আগে কোথাও দেখেছি-বার বার মনে হচ্ছে এ কথাটা। কোথায়? অন্য কোনও দোকানে? কোনও ফ্যাশন শোতে?
উঁহু, দোকানে নয় বা কোন স্টলে নয়! ব্লাউজটা যেন আমারই ছিল, আমি নিজেই পরেছি কোন এক সময়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব?
যতই মনে করার চেষ্টা করলাম, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল স্মৃতি। ক্যামেরায় তোলা ছবির মত ভেসে উঠল মনের পর্দায়। চোখ বুজে মনের চোখে ছবিগুলো দেখার চেষ্টা করলাম।
জোরাল একটা গুঞ্জন কানে এল। মনে হলো ছাতের কাছ থেকে আসছে। অনেক বেড়ে গেল শব্দটা। মাথার ওপর ফ্লোরেসেন্ট লাইটগুলো মিটমিট করতে করতে নিভে গেল।
অন্ধকার!
হঠাৎ থেমে গেল গুঞ্জন। আলো জ্বলে উঠল আবার।
ভয় পেয়ে গেলাম। ছুটে বেরোলাম বদ্ধ ঘরটা থেকে। ক্লডিয়া যেখানে থাকার কথা, সেখানে নেই। তার জায়গায় অন্য এক মহিলা। চুলের ছাঁট থেকে শুরু করে মেকআপু, জুতো সবই সেকেলে। অনেক পুরানো ফ্যাশন। আরও ঘাবড়ে গেলাম। মগজের গোলমাল হয়নি তো আমার!
ক্লডিয়ার চেয়ে কোন দিক দিয়েই ভাল নয় এই মহিলাটিও। নেম-ট্যাগে নাম লেখা: গ্যারেট। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, চেঞ্জিং রুমে কি করছিলে?
চেঞ্জিং রুমে কি করছিলাম মানে? আমি অবাক।
আমি জানতে চাইছি, কি পরছিলে?
নাহ, দোকানটার বদনাম না করে আর পারছি না। এখানকার সব কর্মচারীই দেখা যাচ্ছে ক্লডিয়ার মত। ভাল ব্যবহার শেখেইনি। কিছুটা রুক্ষস্বরেই জবাব দিলাম, গায়ে যে ব্লাউজটা দেখছেন, এটাই পরছিলাম।
চারপাশে তাকিয়ে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ করলাম। কোন কিছুই যেন স্বাভাবিক লাগছে না। ঘটছেটা কি এখানে! কয়েক মিনিট আগে যে ডেকোরেশন দেখে গিয়েছিলাম, সেটা বদলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কি করে বদলাল?
দেখো মেয়ে, ধমকের সুরে বলল গ্যারেট, আমার দোকানের মধ্যে কোন রকম গণ্ডগোল চাই না। যাও, বেরোও!
কিন্তু…আমি…
এক্ষুণি! আরও জোরে ধমকে উঠল গ্যারেট। কি সব পোশাক পরেছে দেখো! বিচ্ছিরি! আমার কাস্টোমাররা তোমাকে দেখে চমকে যাচ্ছে। যাও, যাও, বেরোও!
এতক্ষণে লক্ষ করলাম, দোকানের সব লোক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমি একটা চিড়িয়া। হাঁ করে দেখছে।
যাচ্ছি। তবে একটা কথা, ম্যাম, বলতে ছাড়লাম না, ওদের চমকে যদি কেউ দিয়েই থাকে, সেটা আমি না, আপনি।
কি বললে?
ঠিকই বলেছি। পাগলের চেয়ে ডাইনীকে অনেক বেশি ভয় করে লোকে।
জবাব আটকে যাওয়ায় মরা মাছের মত হাঁ হয়ে গেল। গ্যারেটের মুখ। প্রতিশোধ নিতে পেরে খুশিমনে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।
*
পথে বেরিয়ে হতবাক। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো শহরটাই কেমন পাল্টে গেছে। মানুষজন, জিনিসপত্র, সব কিছু এক লাফে যেন ফিরে গেছে তেরো বছর আগে। কি বিচ্ছিরি সব পোশাক পরেছে লোকে। প্যান্ট, জুতো! আহা, কি ছিরি! ওয়াক! বমি আসে দেখলে! আর একটা ব্যাপার, সবাই শীতের পোশাক পরেছে।
সন্দেহ হলো। একটা দোকানে ক্যালেন্ডার ঝোলানো দেখে সেদিকে এগোলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ১৯৮৭-র শীতকাল। এক লাফে এক যুগের বেশি পেছনে চলে এসেছি। অবিশ্বাস্য! এ কি করে সম্ভব!