প্রাণপণে দৌড়াতে থাকলাম। পেছন ফিরে তাকালাম না আর। যখন মনে হলো, আর পারব না, ধরা পড়ে যাবে, ঠিক তখন চোখে পড়ল সার্ভিস স্টেশনের আলো। পাহাড়ের মাথায়। বাবা সম্ভবত ওখানেই গেছে মেকানিকের খোঁজে। কুয়াশায় উজ্জ্বল হতে পারছে না আলোটা, ঘোলাটে গোল একটা আভা। যা-ই হোক, এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেলাম।
কিন্তু পাহাড়ের ঢালটা চোখে পড়তে দমে গেলাম। ওটা বেয়ে দৌড়ে ওঠা সহজ নয়। ধরে ফেলবে আমাকে গুণ্ডাগুলো। পেছনে চলে এসেছে।
তাই বলে থামলাম না। খোয়া বিছানো একটা রাস্তা উঠে গেছে চূড়ায়। সেটা ধরে উঠতে গিয়ে শরীর বাঁকা হয়ে গেল সামনের দিকে। পিছলে গেল স্যান্ডেল। পড়ে গেলাম উপুড় হয়ে। হাতের আঙুলগুলো নিজের অজান্তেই কাদায় বসে গিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরল। হাঁপাতে হাঁপাতে বুক ব্যথা হয়ে গেছে।
ধরে রাখতে পারলাম না। আঙুলের সঙ্গে উঠে এল নরম মাটি। পিছলাতে শুরু করলাম। খানিকটা পিছলে নামার পরই গড়ানো শুরু করলাম। ধারাল পাথরের আঘাতে কেটে যেতে লাগল কপাল, কনুইয়ের চামড়া। পড়ে গেলাম কাদাপানিতে ভরা ছোট একটা গর্তের মধ্যে।
তোলো ওকে! চিৎকার করে বলল জলহস্তী। চোখেমুখে এখনও মাখন লেগে রয়েছে। এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে, যেখানে লেগেছিল গাড়ির দরজা। ওর বারোটা বাজাব আমি আজ!
এ দুজন এসে দুদিক থেকে ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমাকে।
খুব চালাক ভারো নিজেকে, তাই না? বলল ওদের নেতাটা।
না, তা আমি ভাবি না, জবাব দিলাম। ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে আমার। খিদেয় পেট জ্বলছে। যে ভেজা ভিজেছি, সর্দি লেগে যাবে জানা কথা। বেপরোয়া হয়ে উঠেছি। কাজেই কথা বলতে পরোয়া করলাম না। আর কি ভাবছি শুনবে? ভাবছি, সকালে কার মুখ দেখে আজ ঘুম ভেঙেছিল, তোমাদের মত একদল ঘেয়ো কুত্তার সামনে পড়তে গেলাম।
আমার চারপাশ ঘিরে ঘুরতে শুরু করল নেতাটা। রাগে কথা বেরোচ্ছে না মুখ থেকে। ঢোক গিলোম। কিন্তু যা বলার বলে। ফেলেছি, ফিরিয়ে নেয়া যাবে না আর।
ঘেয়ো কুত্তা হই আর যা-ই হই, কর্কশ কণ্ঠে বলল ওদের নেতা, তোমাকে একটা শিক্ষা না দিয়ে ছাড়ব না আজ, বিচ্ছু মেয়ে কোথাকার! রিকোর যা অবস্থা করেছ, জলহস্তীকে দেখাল। সে, তার জন্যে শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
অ, মোটকুর নাম তাহলে রিকো! চুকচুক শব্দ করলাম জিভ দিয়ে। মুখ ফসকেই যেন বেরিয়ে গেল, আমি তো ভেবেছিলাম হিপো, হিপোপটেমাস।
চুপ…! মুখ খিস্তি করে গালি দিল জলহস্তী। গর্জন করে। বলল, আজ তোকে আমি…!
কালো জ্যাকেটের নিচ থেকে টান দিয়ে বের করল কি যেন। বোতাম টিপতে ঝটাৎ করে খুলে গেল আট ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের ফলা। একটা সুইচব্লেড।
আমাকে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, না! আমি হিপো? ছুরির মাথাটা আমার পেটের দিকে তাক করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রিকো, মজাটা আজ টের পাওয়াব।
এক পা এগিয়ে এল সে।
দম বন্ধ করে পেটে ছুরি খাওয়ার অপেক্ষায় আছি। হাঁচি দিয়ে ফেললাম। হাঁচি দেয়ার মোটেও উপযুক্ত সময় নয় এটা। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে, কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে, পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে আমার অবস্থা তখন বড়ই শোচনীয়।
আচমকা ঝলকে উঠল লালচে-সাদা তীব্র আলো। আকাশের বিদ্যুতের মতই অসংখ্য বিদ্যুতের শিখা উঠে আসতে শুরু করল আমার পায়ের কাছ থেকে। আমাকে ঘিরে, আমার সমস্ত দেহ ঘিরে, ছড়িয়ে পড়ল কাদাপানিতে; সরু সরু আলোর সাপের মত ছুটে গেল আমার শত্রুদের দিকে।
সবগুলোকে জীবন্ত জালের মত জড়িয়ে ফেলতে লাগল সেই রঙিন বিদ্যুৎ-শিখা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল ওরা। পাগলের মত নাচতে লাগল কাদার মধ্যে। হাত-পা ছুঁড়ে সেই বিদ্যুৎ-বিভীষিকার কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে।
দৃশ্যটা দ্রুত মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। তারপর সব, অন্ধকার।
.
১৩.
জেগে উঠে চারপাশে বিচিত্র সব পোশাক পরা মানুষকে দেখতে পেলাম। হাসপাতালে রয়েছি। পায়ের কাছে দাঁড়ানো মহিলা ডাক্তার। ধূসর-চুল। বুকে লাগানো নেম-ট্যাগে নাম লেখা শেলী অলরিজ। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। সাংঘাতিক উদ্বিগ্ন। বাবার পাশে দাঁড়ানো একজন পুলিশ অফিসার।
পুলিশ কেন?
কাল থেকে সেই যে শুরু হয়েছে-আমার আতঙ্কের প্রহর কি আর শেষ হবে না!
আমি ওই ব্লাউজ চুরি করিনি! চিৎকার করে উঠলাম। জীবনে কারও জিনিস চুরি করিনি আমি!
কিসের ব্লাউজ? জানতে চাইল অফিসার।
চুরির অভিযোগে তোমাকে দায়ী করা হচ্ছেও না, ঘরের আরেক পাশ থেকে বলে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। সেদিকে তাকাইনি, তাই দেখিনি এতক্ষণ-এখন দেখলাম, পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান। ফ্লেচার। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন তিনি।
চুপ করে থাকো, হনি, আস্তে করে বাবা আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিল। চুপচাপ শুয়ে থাকো। কোন চিন্তা কোরো না।
কিন্তু ও কিসের কথা বলল? চুরির প্রসঙ্গ টেনে আনতে চাইছে অন্য অফিসার।
আহ, থামো তো, ডেরিয়াল, ক্যাপ্টেন বললেন। মেয়েটা অসুস্থ। তাকে এ সময় বিরক্ত করার কোন দরকার আছে?…রিটা, আমাদের আসার কারণটা তোমাকে বলি। কিছুক্ষণ আগে তোমার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। মনে আছে?
ধীরে ধীরে স্মৃতিটা ফিরে আসতে শুরু করল আমার। গাড়িতে আটকা পড়া…বনের মধ্যে ছোটার দুঃস্বপ্ন…আমাকে ঘিরে ছড়াতে থাকা বিদ্যুতের জাল হাসপাতালে রয়েছি যখন, নিশ্চয় আমাকে ছুরি মেরেছে…