কি জানি, এমন কোন বোমাও রেখে থাকতে পারে, যেটা হাত কা। খুব সাবধানে ডালা খুলোম। সিনেমায় দেখেছি, বাক্সে ভর। বোমার ডালা খুলতে গেলেই বুম করে ফাটে। ভেতরে তার-টার দেখলাম না। টিক টিক করে ঘড়িও চলছে না। কেকের গায়ে লেখা রয়েছে: হ্যাপি বার্থডে, রিটা।
এটাই কি বিপদ? এই কেক? হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল। মনকে ধমক দিলাম: নির্জেকে সামলানোর চেষ্টা করো, রিটা! পাগলামি শুরু করেছ তুমি!
বিদ্যুৎ চমকাল আবার। কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে আসতে দেখলাম। নিশ্চয় মেকানিক নিয়ে ফিরে এসেছে বাবা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কেকের কথাটা বাবাকে বললে হেসেই খুন হবে।
কাছে এসে দাঁড়াল সবচেয়ে আগের মূর্তিটা। দরজার লক খুলে দিয়ে, হাতল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামালাম। বাবা ভেবে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, মেকানিক পেয়েছ?
এই সময় চেহারাটা চোখে পড়ল।
বাবা নয়। কিন্তু চেনা চেনা লাগল। কোথায় দেখেছি? কোথায় দেখেছি? হ্যাঁ, মনে পড়ল। দেখেছি মলের দেয়ালে। পোস্টারের ছবিতে। যেখানে অপরাধীদের ছবি সাঁটানো হয়। এই গুণ্ডাটার চেহারার পাশেই হয়তো এতক্ষণে মলের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আমার মুখটাও। ভাবতে কালো হয়ে গেল মনটা।
আতঙ্কটা আসতে সময় লাগল। ধীরেই এল। তবে, এল। মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি। দ্রুত কাঁচটা নামিয়ে দিতে গেলাম। চট করে একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। ভেতরে ঠেলে দেয়ার আগেই তুলে দিতে পারলাম কাঁচটা। ভাগ্যিস গাড়িটাতে চাইল্ড লক আছে। দরজাটা খুলতে পারল না তাই। পটাপট যতখানে যতগুলো লক আছে, সব লাগিয়ে দিলাম।
তারপরের দৃশ্যটা হরর সিনেমার ভয়াল দৃশ্য বললে কম বলা হবে। চুপচুপে ভেজা ফ্যাকাসে চামড়া, চোখা নাক, মাথায় লেপটানো নানা রঙের চুলওয়ালা যুবকগুলোকে দেখে মনে হলো নরক থেকে উঠে এসেছে। মোট চারজন ওরা। গাড়ি ঘিরে ঘুরতে শুরু করল। থেকে থেকে চামড়ার দস্তানা পরা হাত দিয়ে চাপড় মারতে লাগল জানালার কাঁচে।
হাই, বেবি, দাঁত বের করে হাসল ওদের লাল-চুলো নেতাটা, যার ছবি মলে সাঁটানো আছে, বেরিয়ে এসো। কি বসে আছ, গাড়ির মধ্যে।
হ্যাঁ, চলে এসো, সুর মেলাল আরেকজন। এই গরমে বৃষ্টিতে ভিজতে বড় আরাম। শরীরটা তার এত মোটা, ছোটখাট একটা জলহস্তী মনে হচ্ছে। কপালে উল্কি দিয়ে সাপ আঁকা।
খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই তোমাদের? চিৎকার করে জবাব দিলাম। বৃষ্টিতে ভেজার চেয়ে বরং গাঁজায় দম দাওগে। ইচ্ছে করলে ড্রাগও নিতে পারো। এখানে আমাকে জ্বালাতে এসেছ কেন?
গাড়ির ট্রাংকে উঠে লাফাতে শুরু করল একজন। অন্য আরেকজন বুট পরা পায়ে লাথি মেরে একে একে ভেঙে ফেলতে লাগল হেডলাইট, টেল লাইট, পার্কিং লাইট।
তুমি বললে ড্রাগ-ট্রাগ সবই নেব, খিকখিক করে হেসে জবাব দিল নেতা। কিন্তু, গাড়িতে বসে আছ কেন? বেরোও। বেরিয়ে এসে তারপর বলো। নাকি ভাবছ ওখান থেকে তোমাকে বের করে আনতে পারব না আমরা?
জাহান্নামে যা, শয়তানের দল! চিৎকার করে উঠলাম আমি।
গাড়িটাকে দোলাতে শুরু করল ওরা। ভাগ্যিস ভলভো, গাড়িগুলো খুব মজবুত করে বানায় কোম্পানি। দোলানোর চোটে গা গুলিয়ে উঠল আমার। ভয় পেয়েছি সেটা বুঝতে দিলাম না ওদের, চিৎকার করে বললাম, এ গাড়ির মধ্যে জীবনেও ঢুকতে পারবি না তোরা। এটা কি জানিস? ভলভো এস সেভেন্টি। গাড়ির জগতে সবচেয়ে শক্তগুলোর একটা।
পাথর দিয়ে বাড়ি মারল জলহস্তীটা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল ড্রাইভারের পাশের জানালা। ফোকর দিয়ে মাথা গলিয়ে বলল সে, সরি! তোমার ছোট্ট বাহনটার ক্ষতি করে ফেললাম না তো?
কেকটা ব্যবহার করার সময় এসেছে। খানিক আগে কাগজে দেখা লেখাটার কথা মনে পড়ল। আশ্চর্য! কিভাবে সতর্ক করে। দিল আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়!
বাক্স থেকে কেকটা বের করে যতটা জোরে সম্ভব বসিয়ে দিলাম ওর মুখে। কেক, মাখন, সব ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে। দলা দলা আটকে গেল ওর নাকে-মুখে, চুলে, মাথায়।
সরি, চিৎকার করে ওর কথাতেই জবাব দিলাম, তোমার ছোট্ট মুখটার কোন ক্ষতি করে ফেললাম না তো?
মুখ খারাপ করে একটা গালি দিল সে। চোখ থেকে আঠাল চকলেট বের করার চেষ্টা করছে। আমি তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব!
ধরতে পারলে তবে তো, বলেই ওদিককার দরজার লকটা নামিয়ে, হ্যাঁন্ডেলে মোচড় দিয়ে, জোড়া পায়ে লাথি মারলাম দরজার গায়ে। আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লাগল জলহস্তীর মোটকা ভুড়িতে। হুক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল তার পেট থেকে। চিৎ হয়ে পড়ে গেল কাদার মধ্যে।
দলের বাকি তিনজন রয়েছে অন্যপাশে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় লাগালাম বনের দিকে।
১২.
এত বছরের চীয়ারলীডিং প্র্যাকটিস কাজে লাগল এখন। প্রায় উড়ে পার হয়ে এলাম খোয়া আর কাদাপানিতে ভরা রাস্তা। ঢুকে পড়লাম ঝড়ে উন্মত্ত বনের মধ্যে। যে ভাবে কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম, কপাল ভাল গাছের গায়ে কপাল ঠুকে গেল না। ডালপাতার বাড়ি লাগছে মুখে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে সরানোর চেষ্টা করতে করতে ছুটলাম। ভেজা কাপড় সেটে আছে গায়ের সঙ্গে। ডালপাতা, কাঁটালতা জড়িয়ে যাচ্ছে হাতে পায়ে, আঁকড়ে ধরছে। তবুও বনটা এখন গাড়ির চেয়ে নিরাপদ।
জীবনেও এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে দেখিনি আমি। সারা আকাশটাতে জালের মত বিছিয়ে যাচ্ছে তীব্র নীল শিখা। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রের গর্জন। যেন কোন অজানা দানবেরা দল বেঁধে পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম। নীলচে-সাদা বিদ্যুতের আলোয় ঠিক আমার পেছনেই লেগে থাকতে দেখলাম গুণ্ডাগুলোকে।