হ্যাঁ, জবাব দিল বাবা। মল থেকে যখন ফোন পেলাম, তখনই বুঝতে পারলাম তোমার মনের অবস্থা কি হবে। তোমাকে খুশি করার জন্যে কেকটা কিনে নিয়েছিলাম।
বললাম না, পৃথিবীতে আমার বাবা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু!
বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব, বাবা, নাক টানলাম। ঠাণ্ডাটা ধরতে আরম্ভ করেছে মনে হয়। আমি সত্যিই এখন। খুশি।
বুনো অঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন। গাড়ির ছাতে তবলা বাজাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। কুয়াশা এত ঘন হয়ে গেছে, সামনে পনেরো ফুট দূরেও দৃষ্টি চলে না।
আর ঠিক এই সময় ঘটল অঘটনটা।
১১.
দম নেয়ার জন্যে থামল রবিন।
কিন্তু চুপ থাকতে দিল না তাকে মুসা আর জিনা।
থামলে কেন? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পড়ো পড়ো! তারপর?
অঘটনটা কি? জিনাও উত্তেজিত। পড়ো জলদি!
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে রবিনের! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করল:
চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির ইঞ্জিন। চুপ হয়ে গেল। রেডিও। বাতি নিভে গেল। যেন চলতে চলতে মরে গেল গাড়িটা।
কোনমতেই স্টার্ট করতে না পেরে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা আর টর্চ হাতে নেমে গেল বাবা। হুড তুলে খানিকক্ষণ ইঞ্জিনের এটা ওটা নাড়াচাড়া করল। চালু করতে পারল না।
ফিরে এসে ড্রাইভিং সীটে বসল বাবা। আশ্চর্য! মনে হচ্ছে কেউ যেন ব্যাটারির সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। অলটারনেটর ঠিক, কোন লীকটিক নেই…
বজ্রপাতের জন্যে নয় তো? জিজ্ঞেস করলাম।
হতে পারে…কিংবা ভিনগ্রহবাসীর মহাকাশযান, রসিকতা করল বাবা। ইদানীং রকি বীচের বাসিন্দারা কিভাবে ইউ এফ ও নিয়ে মেতে উঠেছে, জানা আছে তার।
দূর, ইউ এফ ও না ছাই। আকাশে তো কোন আলোই দেখছি না।…কি করব এখন?
কাছেই একটা গ্যাস স্টেশন আছে। মেকানিক আছে কিনা দেখতে পারি গিয়ে। তুমি গাড়ির মধ্যে বসে থাকো। গাড়ি পাহারা দাও। নেকড়েরা ঘিরে ধরলেও গাড়ি থেকে বেরোবে না।
এই শেষ কথাটাও বাবার রসিকতা। একটা সিনেমায় বনের মধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ছবির বাবাকে বেরোতে হয়েছিল তার মেয়েকে রেখে। নেকড়েরা ঘিরে ধরেছিল গাড়িটা। ভয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাতে চেয়েছিল মেয়েটা। মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে তার।
কথাটা মনে করিয়ে বাবা বরং ভয় ধরিয়ে দিল আমার। বাইরের অবস্থাটা খুব খারাপ। চাঁদ নেই। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। গাড়ি খারাপ হয়েছে একেবারে নির্জন জায়গায়।
ছাতা আর টর্চ হাতে আবার বেরিয়ে গেল বাবা। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে নেচে নেচে এগিয়ে যেতে দেখলাম টর্চের আলোটাকে। কমতে কমতে হঠাৎ মিলিয়ে গেল। বাবাকে গিলে নিল যেন প্রবল বৃষ্টিপাত আর ঘন কালো অন্ধকার।
একা বসে রইলাম গাড়ির মধ্যে।
তবলায় টোকার বিরাম নেই। গড়িয়ে গড়িয়ে আসতেই আছে কুয়াশা। পেঁজা তুলোর মত ঘিরে ফেলছে সব কিছুকে। বিদ্যুৎ নেই, উইশীল্ড ওয়াইপার চলতে পারছে না। সামনের জানালার বাইরেটাকে লাগছে একটা ভেজা ব্ল্যাকবোর্ডের মত।
নিজের অজান্তে গায়ে কাঁটা দিল। গাড়ির মধ্যে থাকাটা। নিরাপদ কিনা বুঝতে পারলাম না। এ সব নিয়ে যতই ভাবব, ভয়। বাড়তে থাকবে। তাই বর্তমানের ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে দূর করে দিয়ে অন্য চিন্তায় মন দিলাম। সারাটা দিন যা যা ঘটেছে, বিশেষ করে মলে, সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। বাবা হয়তো ঠিকই বলেছে, কল্পনাতেই আমি সময় পেরিয়ে গিয়েছিলাম। একটা ঘোরের মধ্যে চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে দোকানের বইরে চলে গিয়েছিলাম। ক্লডিয়া অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল বলে আমাকে দেখেনি।
কিন্তু কল্পনা কি এত বাস্তব হয়? নাকি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার? উল্টোপাল্টা, ভুলভাল সব দেখেছি! এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল মন, যেখানে কল্পনা আর বাস্তবের প্রভেদ বোঝা কঠিন ছিল।
পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো?
অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসতে গেলাম। সীট বেল্ট পরাই আছে। খুলতে যেতেই স্কার্টের পকেটে খসখস করে উঠল কিছু। একটা কাগজ। বিজ্ঞাপনের ছেলেটা দিয়েছিল।
এক সেকেন্ড! বিজ্ঞাপন!…এই তো প্রমাণ! এতক্ষণ মনে পড়েনি। আর কোন সন্দেহ নেই। কল্পনা নয়। সত্যি সত্যি সময় পেরিয়ে অতীতে চলে গিয়েছিলাম আমি।
পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়ার চেষ্টা করলাম। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ চমকাল। সবুজ রঙের কাগজ। আবার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় রইলাম। যতবার চমকাল, একটু একটু করে পড়তে লাগলাম। দোকানটার গুণগান করেছে। ক্রিসমাসে কিছু জিমিস খুব সস্তায় পাওয়া যাবে, সেকথা লিখেছে। তবে আমার কথার সপক্ষে প্রমাণ করার মত তারিখ বা সন লেখা। নেই।
পেছনটা উল্টে দেখলাম। আকাশ চিরে দিল বিদ্যুতের নীল শিখা। গুড়গুড় শব্দ কেঁপে কেঁপে চলে গেল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্পষ্ট যেন একটা পরিচিত হস্তাক্ষরে লেখা দেখতে পেলাম:
না, তুমি পাগল নও।
তবে মস্ত বিপদের মধ্যে রয়েছ।
কেকটা বের করে হাতে নিয়ে নাও।
এখনই।
লেখা বলছে পাগল নই, কিন্তু আমার মনে হলো বদ্ধ পাগল হয়ে গেছি, একেবারে উন্মাদ। কেক বের করলে কি হবে?
আবার পড়তে গেলাম লেখাটা। নেই। সেই ফোন নম্বরটাই শুধু। নাহ, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছি! ভয় দুর্বল করে দিল আমাকে। কিন্তু কৌতূহল দমাতে পারলাম না। আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতে কাত হয়ে পেছনের সীট থেকে তুলে আনলাম কেকের বাক্সটা। কিন্তু তেমন ভারী লাগল না। বোমা থাকলে নিশ্চয় অনেক বেশি ভারী হত।