সর্বনাশ হবে! এই মলে ঢোকার এখানেই ইতি। রকি বীচেও টিকতে পারব কিনা সন্দেহ। স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা জেনে যাবে, শিক্ষকরা জানবে, পাড়া-পড়শীরা জানবে; হাত তুলে দেখাবে আর হাসাহাসি করবে-ওই যে চোরনি রিটা যায়! কোনমতেই সহ্য করতে পারব না। এতক্ষণ এত গালাগাল অপমানেও যা হয়নি, তা-ই হলো, চোখ ফেটে পানি এল আমার। যে অপরাধটা আমি করিনি তার জন্যে এতবড় শাস্তি আমাকে না দিলেও পারত ওরা।
আমার হাত ধরে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল বাবা। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। পার্কিং লটের চত্বর ধরে গাড়ির দিকে। এগোলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম।
গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে বাবা। এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেলাম, বাবা, ব্লাউজটা আমি চুরি করিনি।
থাক, ও নিয়ে আর আলোচনার দরকার নেই। দোষটা আমারই। বাবার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করিনি আমি।
বাবা, সত্যি বলছি, ওটা আমি চুরি করিনি! বিশ্বাস করো!
যা হবার হয়ে গেছে। এখন থেকে আরও বেশি সময় দেব তোমাকে। আমার হাতে চাপ দিল বাবা।
বাবা, তুমি আমার কথা শুনছ না। আমি বলছি, আমি চুরি করিনি। সব দেখেশুনে চুরিই মনে হতে পারে, কিন্তু যা ঘটেছে সেটা সাংঘাতিক।
পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে নীরবে কয়েক মিনিট গাড়ি চালাল বাবা। ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগতে থাকলাম আমি। অবশেষে বাবা বলল, বেশ, বলো, কি ঘটেছে। আমি শুনছি।
ভেজা চুলে হাত বোলালাম। ঠোঁট কামড়ালাম। বাবাকে সব কথা বলি আমি, কোন কিছু গোপন করি না। বাবা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমাকে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজকের ঘটনাটা। কি করবে?
বাবা, যে কথাটা আমি বলব এখন, কথা দিতে হবে চুপ করে। শুনবে। কথার মাঝখানে কোন মন্তব্য করবে না। কোন পরামর্শ দেবে না।
ঠিক আছে, কথা দিলাম।
ঘটনাটা হলো.. ঢোক গিলোম। দ্বিধা যাচ্ছে না আমার। শেষমেষ বলেই ফেললাম, বাবা, আমি সময় পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
মাথা ঝাঁকাল বাবা, বলো, আমি শুনছি।
বাবা, ব্লাউজটা পরে দেখার জন্যে চেঞ্জিং রুমে ঢুকেছিলাম। হঠাৎ আলোগুলো মিটমিট শুরু করল। বিচিত্র শব্দ হতে লাগল। আবার আলো জ্বললে যখন বেরিয়ে এলাম, আমি এক ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছি। বাবা, সেটা উনিশশো সাতাশি সাল।
বাবাকে বিশ্বাস করতে বলছি, অথচ তখনও আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না; সত্যি সত্যি আমি অন্য সময়ে চলে গিয়েছিলাম।
উনিশশো সাতাশি? তেরো বছর আগে?
হ্যাঁ, বাবা। আমার কথা বিশ্বাস করছে কিনা বুঝতে পারলাম না। রাস্তার মোড়ের বিখ্যাত সেই অ্যামোজ কুকিস স্ট্যান্ডটা, যেটাতে প্রায়ই আমরা কুকিস কিনতে যেতাম…
এক সেকেন্ড, রাস্তা থেকে মুহূর্তের জন্যেও নজর সরাচ্ছে না। বাবা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসে শুকনো-শ্যাওলা-ভেজা গন্ধের মত গন্ধ, গরমকালে বৃষ্টির সময় যা হয়। বেশি স্পীড়ে চালানোর সময় কথা বললে অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারে, তাই গতি কমাল বাবা। হ্যাঁ, এবার বোঝার চেষ্টা করে দেখা যাক, এ ধরনের কল্পনা কেন করতে গেলে তুমি।
দমে গেলাম। অ, তারমানে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না! তুমি ভাবছ, মিথ্যে কথা বলছি!
আমি কি বলেছি, মিথ্যে বলছ? সত্যি কথাই বলছ তুমি, ডাক্তারী-কণ্ঠে বলল বাবা, ফোনে রোগীদের সঙ্গে এ ভঙ্গিতে কথা বলতে বহুবার শুনেছি। অনেক সময় কিছু কিছু ঘটনা একেবারে বাস্তব মনে হয়, কিন্তু আসলে সেগুলো বাস্তব নয়। মন আমাদের সঙ্গে চাতুরি করে। কল্পনা বাস্তবতাকে দাবিয়ে দেয়।
হা কপাল! বিড়বিড় করলাম। কেউ আমার কথা বুঝছে না, বিশ্বাস করছে না, এমনকি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধুটিও নয়। কেউ না! কেউ না!
রিটা, বাবা জবাব দিল, সত্যিই বলেছ, আমি তোমার এত ঘনিষ্ঠ, এত কাছের মানুষ হয়েও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি তোমাকে। কি করে বুঝব? আমি তো আর তোমার বয়েসী কিশোরী ছিলাম না কখনও। সেটা তোমার মা হলে পারত।…উনিশশো সাতাশি বললে না? এই সালটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তোমার মা মারা গিয়েছিল ওই বছর। আজকে তোমার জন্মদিন। এই দিনে মাকে তোমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে, এটাই স্বাভাবিক।
তারমানে, ধীরে ধীরে বললাম, তুমি বলতে চাও, মাকে দেখার ইচ্ছে আমার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, কোনভাবে সময়কে ডিঙিয়ে পেছনে চলে গিয়েছিলাম?
না, ঠিক তা নয়। তবে মাকে দেখতে এতই ইচ্ছে করছিল, তোমার মনে হয়েছে তোমার মায়ের বেঁচে থাকার সময়টায় চলে গেছ।
তারমানে এখনও তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না! কান্না এসে যাচ্ছিল আমার, জোর করে ঠেকালাম। বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বড় বড় ফোঁটা ক্রমাগত আঘাত হানছে জানালার কাঁচে।
আমি বিশ্বাস করি বা না করি, রিটা, বাবা বলল, সত্যিই যদি তুমি পিছিয়ে চলে গিয়ে থাকো, সাংঘাতিক ভাগ্য বলতে হবে তোমার। কতবার আমি পিছিয়ে যেতে চেয়েছি সেই সময়টাতে…কিন্তু কখনও পারিনি।
হঠাৎ করেই বাবার জন্যে বড় মায়া লাগল। বেচারা! মাকে অসম্ভব ভালবাসত। মার কথা মনে হলে ভীষণ কষ্ট পায়। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে রাখলাম। পাশে কাত হয়ে আমার মাথায় চুমু খেল বাবা।
ঘুরে পেছনে তাকালাম। পেছনের সীটে রাখা লাল কাগজে মোড়া একটা বড় বাক্স। ওটা আমার জন্মদিনের কেক, তাই না?