পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার রনসন। কাঁপছেন থরথর করে। দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি আমি, কম্পিত স্বরে বললেন।
আমাদের জিনিসগুলো? কিশোর বলল।
আরেক দিন এসে নিও।
কাউন্টারে রাখা মুদ্রাটা হাত দিয়ে টেনে সরিয়ে আনল কিশোর। তুলে নিয়ে পকেটে ভরল। হতাশ কণ্ঠে বলল, সিসি। হেনরি। চলো, যাই।
দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা। দড়াম করে মিস্টার রনসনকে পাল্লা লাগাতে শুনল। তালা আটকে দিলেন তিনি।
রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময়, পথচারীদেরকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল কিশোর। সবার চোখ সিসির গলার সাপটার দিকে। একটা বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল এক মহিলা। ঝট করে পর্দা টেনে দিল। দেখেও দেখল না সিসি। আপনমনে হেঁটে চলল।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল কিশোর। যত তাড়াতাড়ি বনের কাছে পৌঁছানো যাবে, সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবে।
*
সেদিন রাতে। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল কিশোর। দ্বিধায় পড়ে গেছে। ঘুম ভাঙাল কিসে?
শব্দটা কানে এল আবার। একজন মানুষের কণ্ঠ,। খসখসে। ক্রুদ্ধ।
একজন নয়। আরও মানুষের কথা বলার শব্দ কানে আসতে লাগল।
ঘোড়ার খুরের ভোঁতা শব্দ শোনা গেল। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়া শুরু হলো যেন তার।
জোরাল হতে লাগল খুরের শব্দ।
এগিয়ে আসছে।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে শার্টটা গায়ে দিল। ওপরে চাপাল ওভারঅল।
কারা আসছে? কি চায়?
জানালার কাছে দৌড়ে এল সে। বাইরে ঘন কালো রাতের অন্ধকার। ঘোড়ার তীক্ষ্ণ ডাক কানে এল। সেই সঙ্গে মানুষের রাগত চিৎকার।
দেখতে পেল লোকগুলোকে। বাড়ি ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। শিকার কোণঠাসা করা নেকড়ের পালের মত।
জিভ শুকিয়ে সিরিশ কাগজের মত হয়ে গেল কিশোরের। চাদিটা দপদপ করতে লাগল। নিচে নামার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল সে।
সামনের পারলারের একধারে দেয়ালে ঝোলানো লং হার্টের রাইফেলটা হুক থেকে খুলে নিল। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা।
সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নেমে এল নিচের বারান্দায়। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখার চেষ্টা করল অন্ধকারে। অস্পষ্ট দেখতে পেল রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে কয়েকটা বড় বড় ছায়া। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দটা কেবল স্পষ্ট।
বারান্দা থেকে নেমে এল কিশোর। চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল কালো মেঘের ঢাকনা। বড় একটা জিনিসকে পড়ে থাকতে দেখল আঙিনায়।
দৌড়ে এল কাছে। প্রচুর রক্তের মাঝখানে বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ে আছে একটা গরু। একরাশ অভিযোগ নিয়ে যেন কিশোরের দিকে স্থির তাকিয়ে রয়েছে নিষ্প্রাণ চোখ দুটো।
০৯.
চিৎকার করে উঠল কিশোর। রাগ যেন টগবগ করে ফুটতে লাগল মগজে। খুনীকে এখন সামনে পেলে নির্দ্বিধায় গুলি করে বসত। গরুটার লম্বা লাল জিভ বেরিয়ে এসেছে মুখের ভেতর থেকে। গলা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে এখনও রক্ত।
মর্মান্তিক দৃশ্যটা সইতে না পেরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গেল কিশোর। গরুর মুখের মধ্যে একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। একটা কাগজ দলা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখের ফাঁকে।
গরুর মুখে কাগজ কেন? হাত বাড়াল কিশোর। লালা আর রক্ত মাখা জিভটায় আঙুল লাগতেই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে আনল। অনুভূতিটা ভয়ঙ্কর। সাবধানে আবার হাত বাড়িয়ে খুলে আনল কাগজটা। চাঁদের আলোয় খুলে দেখল লেখা রয়েছে:
আমাদের গরু মেরেছ, তোমাদের গরু মারলাম।
মেয়েটাকে ঠেকাও।
তুমি না পারলে আমরা ঠেকাব।
বোকা হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ওরা ভাবছে, গরুর মড়ক লাগার পেছনে সিসির হাত আছে। কি অসম্ভব ভাবনা!
মরা গরুটার দিকে তাকাল সে। গরুটাকে জবাই করে রেখে গেছে ওরা। সিসিকেও কি খুন করতে আসবে!
দ্রুত ঘরের দিকে ফিরল কিশোর। সিসির কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্যে। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। সাদা লম্বা নাইটগাউনের ঝুল উড়ছে বাতাসে। বেণী খুলে ফেলায় কালো চুলের বোঝা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সারা কাঁধে। সুন্দরী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। চাঁদের আলোয় বাতাসে দুলন্ত গাউনটাকে অদ্ভুত লাগছে। মুখের ভঙ্গিটাও যেন কেমন।
বোনের পাশে দাঁড়ানো হেনরি। দুই হাত আড়াআড়ি রাখা বুকের ওপর। হেনরির সবুজ চোখ বিস্ফারিত। ঠোঁট কাঁপছে। ভাইয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে তাকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে সিসি।
আর কোন ভয় নেই, অন্যদিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। ওরা চলে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল সে। বন্দুকটায় হাত বোলাল। আবার এলে সোজা গুলি মেরে দেব।
কাগজটায় কি লেখা? জানতে চাইল সিসি।
ও কিছু না… দেখলে ঘাবড়ে যাবে ভেবে দেখাতে চাইল না। কিশোর। তাড়াতাড়ি কাগজটা পকেটে রেখে দিতে গেল।
কিন্তু কাগজটা কেড়ে নিল সিসি। পড়তে পড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
কি করে ভাবতে পারছে ওরা! কেঁদে ফেলল সিসি। কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল উঠানে।
কিশোরের দিকে মুখ তুলে তাকাল সে। চাঁদের আলোতেও ওর চোখের রাগ স্পষ্ট দেখতে পেল কিশোর।
ওরা ভাবছে আমি অশুভ কিছু! চিৎকার করে উঠল সিসি। জাহান্নামে যাক সব! মরুক! আমি ওদের ঘৃণা করি!
*
দুদিন পর। অনিচ্ছুক খচ্চরটার পেছন পেছন ভারী হাল ঠেলে নিয়ে এগোচ্ছে কিশোর, এই সময় দেখতে পেল গ্যারিবাল্ডকে। মুখটাকে আষাঢ়ের মেঘের মত গোমড়া বানিয়ে ভারী পায়ে ইটে আসছে খেতের ওপর দিয়ে।