ও কিছু না। ভয় পাবেন না, আরনিকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর। জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে সহজেই খাতির করে ফেলতে পারে সিসি। নেকড়েটা ওর কিছু করবে না।
কিন্তু শঙ্কামুক্ত হতে পারল না আরনি। কিন্তু ওটা নেকড়ে। গত বছর আমাদের অনেকগুলো গরু-ছাগল মেরে ফেলেছিল নেকড়েতে…আমি…আমি যাই…
দৌড়ে আঙিনা পার হয়ে গেল আরনি। মিনিটখানেক পরেই ওর ঘোড়ার ছুটন্ত পদশব্দ কানে এল কিশোরের। গরুগুলো বাবা করে হাঁক ছাড়ল কয়েকটা। তারপর নাক ঝাড়তে লাগল।
উঠে এসে একটা গরুর কপালে হাত রাখল সিসি। লম্বা জিভ বের করে ওর কনুই চেটে দিল গরুটা।
আরনি এসেছিল কেন? জিজ্ঞেস করল সিসি।
গরুর নাকি কি এক আজব রোগ হচ্ছে, কিশোর বলল।
মুখটা উঁচু করে ধরল সিসি। বাধা দিল না গরুটা। আরনি ধরাতে যেমন করেছিল, তার কিছুই করল না, চুপচাপ দেখতে দিল সিসিকে।
নাহ, আমাদেরটা সুস্থই আছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল সিসি। জন্তু-জানোয়ারের দুঃখ-যন্ত্রণা ওদের মত করেই বুঝতে পারে।
আরনিও বলছিল ভালই আছে, কিশোর বলল। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। তুমি যখন বলছ কিছু হয়নি, তারমানে সত্যি হয়নি, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলাম।
ও ভাল থাকবে, গরুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সিসি। আমাদের একটা গরুরও কিছু হবে না।
না হলেই ভাল। এখন একটা গরু খোয়ানো মানে আমাদের বিরাট ক্ষতি। পাড়া-পড়শীদের গরুগুলোকে যে ভাবে গুলি করে মারতে হচ্ছে…
তার জন্যে কি দুঃখ হচ্ছে তোমার? প্রচণ্ড রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল সিসির চোখে। মরুক না! সব মরে সাফ হোক। শয়তানদের!
কি বলছ তুমি, সিসি!
ঠিকই বলছি। যেমন পাজী, ওদের শাস্তি হওয়াই উচিত। ওরা বলে আমি নাকি ডাইনী!
০৮.
সেই শনিবারে হেনরি আর সিসিকে নিয়ে শহরে গেল কিশোর, দোকান থেকে জিনিস কিনে আনতে। সপ্তাহের এ দিনটিতে এলাকার সমস্ত চাষী বাজার করতে আসে। লোকে গমগম করে শহরটা।
কিন্তু সে দিন লোকের ভিড় দেখা গেল না মোটেও। কাঠের সাইডওয়াক ধরে হাতে গোণা কয়েকজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। কেমন ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। পুরো শহরই যেন শোক পালনে রত।
রনসনস জেনারেল স্টোরের দরজা ঠেলে খুলল কিশোর। পাল্লার ওপরে লাগানো ঘণ্টা বেজে উঠে জানান দিল দোকানে খরিদ্দার ঢুকেছে। শব্দটা অনেক বেশি জোরাল মনে হলো কিশোরের কাছে। কারণ ভেতরে খরিদ্দারের ভিড় নেই, কোলাহল নেই। জুতোর শব্দ তুলে লোহাকাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল কিশোর। তাকে অনুসরণ করল সিসি আর হেনরি।
স্টোররুমের পর্দা সরিয়ে দোকানে ঢুকলেন মিস্টার রনসন। হাসলেন। গুড ডে, কিশোর। তারপর, কেমন আছ তোমরা?
আছি ভালই, জবাব দিল কিশোর। শহরটা এমন নীরব কেন?
সারা হপ্তা ধরেই নীরব, রনসন জানালেন। গরুর রোগ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় আছে লোকে। রোগ সারানোর সব রকম চেষ্টা করছে। কোন লাভ হচ্ছে না। তুমি কটাকে গুলি করলে?
একটাও না।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মিস্টার রনসনের। বলো কি! কি খাইয়ে রোগ সারালে?
আমাদের গরুর রোগই হয়নি।
সন্দেহ জাগল মিস্টার রনসনের চোখে। কেন হচ্ছে না বুঝতে পারছ কিছু?
কেন আবার! আমাদের ভাগ্য ভাল।
সিসির দিকে দৃষ্টি সরে গেল মিস্টার রনসনের। হবে হয়তো।…ভাগ্য ভাল, নাকি অন্য কিছু?
অন্য আর কি হবে?
হুঁ! আনমনে মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার রনসন। অবস্থাটা এমনই এখানকার, কারোরই মন-মেজাজ ভাল নেই। তা কি লাগবে তোমাদের?
কিছু চিনি আর ময়দা, কিশোর বলল। আর সামান্য টিনের খাবার।
পকেট থেকে তার শেষ সম্বল নোটের তাড়াটা বের করে আনল কিশোর। এক হাজার পেসো কাউন্টারে রেখে ঠেলে দিয়ে বলল, এতে যা হয়, দিন।
দাঁড়াও, বাক্সে ভরে দিচ্ছি।
কাউন্টারের ওপাশে নিচু হয়েই স্থির হয়ে গেলেন তিনি। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললেন, এই, তোমরা সরে যাও ওখান থেকে!
কাউন্টারের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল সিসি। দেখল, একটা বাক্স উঁচু করে ধরে রেখেছেন মিস্টার রনসন।
কি হয়েছে, মিস্টার রনসন? জিজ্ঞেস করল সে।
সাপ, ফিসফিস করে জবাব দিলেন মিস্টার রনসন। এত বড় সাপ জীবনে দেখিনি। জলদি গিয়ে দেখো বাইরে কার কাছে বন্দুক আছে।
কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কাউন্টার ঘুরে অন্যপাশে চলে গেল সিসি। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সাপটার কাছে। ঘাবড়াবেন না, মিস্টার রনসন। ও আপনাকে কিছু করবে না।
আস্তে হাতটা বাড়িয়ে দিল সিসি। ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে কিশোর দেখল, বিশাল সবুজ সাপটা ধীরে ধীরে সিসির হাত বেয়ে উঠে আসছে কাঁধের দিকে। ওর গলায় পেঁচিয়ে গেল মালার মত। শয়তানি ভরা কালো চোখের চাহনি সিসির ওপর স্থির। চেরা মাথাওয়ালা লাল জিভটা ঘন ঘন বেরিয়ে আসছে মুখের ভেতর থেকে।
হ্যাচকা টানে হেনরিকে নিজের পেছনে নিয়ে গিয়ে আড়াল করে রাখল কিশোর। সাপটার বাকা বড় বড় বিষদাঁতের দিকে তাকিয়ে শুকিয়ে গেল গলা। ঢোক গিলল বড় করে।
সাপটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সিসি। ফোঁস ফোঁস করছে ওটা। কিশোরের চোখে চোখ রাখল সিসি। ভয় নেই, কিশোরভাই, ওটা আমাকে কিছু করবে না। বাড়ির কাছে গিয়ে বনে ছেড়ে দেব।
কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল সিসি। সাপের লম্বা লেজটা ঝুলে আছে ওর পিঠের ওপর। হাত বাড়িয়ে লেজের ডগাটা ছুঁয়ে দেখল হেনরি। কিশোর ওসব কিছুই করতে পারল না। ভয়ে কেঁপে উঠল সে। জানে, বনের জানোয়ারের সঙ্গে ভাব করতে এক মুহূর্তও লাগে না সিসির। কিন্তু তাই বলে এতবড় একটা বিষাক্ত সাপকে গলায় পেঁচিয়ে রাখা!