কিন্তু কিশোর হাসতে পারল না। সিসির কথা আর হাসি চমকে দিয়েছে তাকে। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল শিহরণ।
০৭.
দিন কয়েক পর। কুড়াল দিয়ে লাকড়ি ফাড়তে ফাড়তে ভাবছে কিশোর-এই একটি কাজ অন্তত জানোয়ারের সাহায্য ছাড়া করা যায়। মাথার ওপর কুড়াল তুলে ঘুরিয়ে কোপ মারল আবার লাকড়ির গায়ে। কাঠের টুকরো ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। একপাশে জমে উঠছে লাকড়ির স্তূপ। লক্ষই নেই সেদিকে। তার মন জুড়ে রয়েছে অচষা জমিটা।
পর পর কয়েকদিন খচ্চরটাকে দিয়ে হাল টানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সে। গ্যাট হয়ে থাকে। কোনমতেই ওটাকে দিয়ে কাজ করাতে পারে না। এগোতেই চায় না। প্রতিরাতে যখন বিছানায় এসে গড়িয়ে পড়ে কিশোর, সারা গায়ে ব্যথা, ক্লান্তিতে ভেঙে আসে, তখনও ঘুম আসতে চায় না তার। গ্যারিবান্ডের মুখটা কুৎসিত, বিকৃত হয়ে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সেই যে পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরে, আর যেতে চায় না।
আজ আসেনি গ্যারিবাল্ড। কাল আসবে। কিংবা পরশু দিন। আসবেই সে, জানে কিশোর। সামান্য যে কটা টাকা আছে আর, তা দিয়ে গ্যারিবান্ডের ঋণ শোধ হবে না। বাড়িটা কেড়ে নেবে গ্যারিবাল্ড।
ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে তখন কোথায় যাবে? কি করবে?
কাফেলার কথাটা প্রথমে পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু এখন যতই ভাবছে, ততই মনে হচ্ছে সে-ই ভাল। চলেই যাবে। আর কোন উপায়ও নেই। এ শহরে কেউ কাজ দেবে না তাকে। খাবার দেবে না! তার চেয়ে মিছিলে যোগ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই উচিত। কি করে এল সে, সেই রহস্যের সমাধানের চেয়ে বেঁচে থাকার চিন্তা করা দরকার আগে।
কুপিয়েই চলেছে কিশোর। কুপিয়েই চলেছে। তার আশঙ্কাটা কোনমতেই প্রকাশ করতে পারে না সিসি আর হেনরির কাছে। মুখ ফুটে বলতে পারে না যে কোন সময় এসে ওদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে গ্যারিবাল্ড। এতিমের মিছিলে ছাড়া তখন আর কোথাও ঠাই হবে না ওদের…
ঘোড়ার খুরের শব্দে ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল তার। কুড়ালটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফিরে তাকাল। ওদের পড়শী। আরনি হুফ। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। পাশাপাশিই থাকে, কিন্তু দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না।
আরনির ছুটে আসার ভঙ্গিতে অশনি-সঙ্কেত দেখতে পেল কিশোর। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ইদানীং দুঃসংবাদের আশঙ্কা দেখলেই এমন হয় তার। হেঁটে গেল সামনের বারান্দার দিকে।
সিঁড়িতে বসে আছে হেনরি। কাঠের একটা খেলনা, ঘোড়ার পা ছুটে গেছে, কোনমতেই লাগাতে পারছে না। লাগিয়ে দিল কিশোর। মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে হাসল হেনরি।
কি হয়েছিল ঘোড়াটার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হাসিটা মুছে গেল হেনরির মুখ থেকে। কথা বলে জবাব দিতে না পারার দুঃখেই যেন জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল।
ওর চুলে আঙুল বুলিয়ে দিল কিশোর। থাক, হেনরি। একদিন তুমি আবার কথা বলতে পারবে।
লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল আরনি। মুখ তুলে তাকাল কিশোর। মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে মৃদু ডাক ছাড়ল ঘোড়াটা।
হাল্লো, আরনি, স্বাগত জানাল কিশোর। কেমন আছেন?
ভাল না, কিশোর। তোমাকে সাবধান করতে এলাম। কি হয়েছে? বুকের মধ্যে কাপুনি উঠে গেল কিশোরের।
অদ্ভুত এক রোগ। গরুর। পাগল করে দিচ্ছে। জানোয়ারগুলোকে। গতকাল ফ্রেঞ্চরা ওদের ছয়টা গরুকে গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছে। আমরা মেরেছি আজকে তিনটাকে।
বলেন কি!
হ্যাঁ, তাই।
কিন্তু আমাদেরগুলোর তো এখনও কিছু হতে দেখলাম না, বলে বারান্দা থেকে নামল কিশোর। অসুস্থ যে সেটা কিভাবে বোঝা যাবে?
ঘোড়া থেকে নামল আরনি। চলো, তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
বাড়ির পেছনে আরনিকে নিয়ে এল কিশোর। পায়ের শব্দে মুখ। ফিরিয়ে দেখল হেনরিও এসেছে পেছন পেছন। তার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।
আমাদের তো আছেই মাত্র কটা গরু, কিশোর বলল। ওখানটায় ছেড়ে রেখেছি চরে খাবার জন্যে। গোয়ালে আর নিই না।
নিচু হয়ে একটা গরুর শিং চেপে ধরল আরনি। মাথা ঝাড়া দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল গরুটা। ডাকতে শুরু করল। কিন্তু শক্ত করে ধরে রাখল আরনি। একবার এপাশে, একবার ওপাশে কাত করে গরুর মুখটা দেখল।
কি দেখছেন? জানতে চাইল কিশোর। হাঁটু মুড়ে বসেছে গরুটার মুখের কাছে। তার পাশে বসে হেনরিও তাকিয়ে আছে কৌতূহলী চোখে।
অসুস্থ হলে নাক দিয়ে সবুজ গাজলা বেরোয়, আরনি বলল। তারপর লাল হয়ে যায়। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে ওঠে গরুগুলো।
খুব খারাপ লোগ মনে হচ্ছে, কিশোর বলল।
খারাপ না হলে কি আর নিজের গরু গুলি করে মারতে হয়। এ রকম রোগের কথা কেউ কখনও শোনেনি। গায়ের লোকে ভাবছে, অশুভ কোন কিছুর ছায়া পড়েছে গাঁয়ে। কিশোরের দিকে তাকাল আরনি, তোমাদের গরুগুলো তো ভালই আছে দেখছি।
এখনও আছে। হতে কতক্ষণ। ভালমত খেয়াল রাখতে হবে। একটা গরু খোয়ালেও মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের।
ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন আরনি। আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ।
কি দেখে এমন হলো আরনির দেখার জন্যে তাকাল কিশোর। পেছনের আঙিনায় একটা নেকড়েকে মুখে তুলে মাংস খাইয়ে দিচ্ছে সিসি।
অস্ফুট একটা শব্দ করে পিছিয়ে গেল আরনি। সিসি, সাবধান! ওটা নেকড়ে! কুকুর নয়! হেনরিকে দেখিয়ে কিশোরকে বলল, বাচ্চাটাকে ঘরে ঢোকাও। বন্দুক নিয়ে এসো।