কিশোর কোন জবাব দেবার আগেই ঝটকা দিয়ে ঘুরে গটমট করে চলে গেল মার্ক। চারপাশে ঘিরে থাকা জনতার দিকে তাকাল কিশোর। কারও চোখে ভয়। কারও রাগ। মিস্টার রনসনকে দেখল চোখে। সহানুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো কথা বলবেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়ালেন মিসেস রনসন। স্বামীর হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাকে।
কেউ আসবে না সাহায্য করতে, বুঝে গেল কিশোর। ফ্রেঞ্চ জিততে পারেনি, জনতার উদ্দেশ্যে বলল সে, আপনারা সবাই দেখেছেন। সিসি জিতেছে। প্রথম পুরস্কারটা তার পাওনা এখন।
সামনে এগিয়ে এল গ্যারিবাল্ড। এ খেলার বিচারক হিসেবে আমার রায়, চালাকি করে জিতেছে সিসি। তার জেতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এমতাবস্থায় তাকে পুরস্কারের টাকা দেয়া উচিত হবে না। জনতার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল সে। আমার রায়ে কারও কোন আপত্তি আছে?
একটা লোকও জবাব দিল না। সবাই নীরব।
সিসি জিতেছে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দিল কিশোর, আপনি তাকে টাকাটা দেন বা না দেন।
দি ইয়াং ম্যান, যথেষ্ট বলে ফেলেছ। আর একটা বাক্যও না। যদি ভাল চাও, ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে এখন বিদেয় হও এখান থেকে, কর্কশ কণ্ঠে বলল গ্যারিবাল্ড।
লোকটার ফোলা ভুঁড়িতে ঘুসি মারার প্রবল ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রাৈধ করল কিশোর। এত রাগ তার কমই হয়েছে। আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেছে।
ব্যাপারটা লক্ষ করল সিসি। তাড়াতাড়ি কিশোরের হাত ধরে টান দিল, এসো, কিশোরভাই। চলো, বাড়ি চলো।…তোমরা এগোও, আমি গোস্টকে নিয়ে আসি।
ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। গ্যারিবাল্ড বা অন্য কারও দিকে একটিবারের জন্যে ফিরে তাকাল না আর। ওদের প্রতি তীব্র ঘৃণাটা বুঝিয়ে দিয়ে হেনরিকে বলল, চলো, হেনরি।
শহর থেকে বেরোনোর রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল সে।
মগজে ওগুলোর একটারও ঘিলু নেই, আনমনে বিড়বিড় করতে লাগল কিশোর। কুসংস্কারে ভরা। নইলে কি আর সিসিকে ডাইনী বলে।
হেনরির দিকে তাকাল সে। নিষ্পাপ চোখ মেলে তার দিকে তাকাল হেনরি। বড় মিষ্টি লাগল মুখটা। রাগ অনেক কমে গেল কিশোরের। ভয় নেই, হেনরি। তোমাদের কিশোরভাই বেঁচে থাকতে তোমাদের একটা চুলও কেউ খসাতে পারবে না। গাঁয়ের লোককে নিয়েও চিন্তা নেই। সিসিকে টাকা দিতে হয়নি, চুকে গেছে। ঘটনাটা নিয়ে আর বিশেষ মাথা ঘামাবে না কেউ।
হেনরিকে বলল বটে, কিন্তু কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না কিশোর। ফ্রেঞ্চদের কোন বিশ্বাস নেই। তাদের সঙ্গে জুটেছে আবার গ্যারিবান্ডের মত একটা ভয়ানক কুটিল পা-চাটা লোক।
শহরের বাইরে চৌরাস্তাটায় এসে সিসির অপেক্ষা করল ওরা। খানিক পরেই গোস্টের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে আসতে দেখা গেল সিসিকে। ঘোড়াটা কাছে এলে হেনরিকে ওটার পিঠে বসিয়ে দিল কিশোর।
কিশোরভাই, সত্যি তুমি আমাদেরকে এতিম আর অসহায়দের মিছিলে দিয়ে দেবে? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল সিসি। গলা কেঁপে উঠল ওর।
ফিরে তাকাল কিশোর। না। ফার্মটা আছে এখনও। মাথার ওপর চালা আছে আমাদের, চাষের খেত আছে; আমরা তো বাস্তুহারা নই।
আশ্বস্ত হলো সিসি। কিন্তু কিশোর হতে পারল না। আর কতদিন ওদের থাকতে দেবে গ্যারিবাল্ডং আজকের ঘটনার পর যে কোনদিন এসে হাজির হবে সে। টাকা দিতে না পারলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। কিছুই করার থাকবে না তখন।
দমিয়ে দেয়া ভাবনাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলল কিশোর। সিসির দিকে তাকাল। হাসল সিসি। দুশ্চিন্তার ছাপ নেই আর। মুখে। হেনরির মুখেও ভয় নেই। এদেরকে অসহায় অবস্থায় বিপদের মধ্যে ফেলে কোথাও চলে যাওয়া এখন অসম্ভব-ভাবছে কিশোর। এমন এক বেকায়দা অবস্থায় পড়েছে, নিজের কথাও ভাবতে পারছে না। নিজে যে কি করে এখানে এল, কে তাকে ফেলে গেল, সেই রহস্যের সমাধান করারও সুযোগ নেই। ছেলে মেয়ে দুটোর একটা কিনারা না করে বাড়ি ফিরে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারছে না। সিসি আর হেনরির একটা গতি না করে এই পরিস্থিতিতে ওদের ফেলে যেতে পারবে না সে।
সিসি, বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল সে, কোন চিন্তা, কোরো না। তোমাদের ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাব না।
তারমানে ব্যবস্থা হলেই তুমি আমাদের ফেলে চলে যাবে! চোখ ছলছল করে উঠল সিসির।
আরি, আবার কাঁদবে নাকি!…থাক থাক, যাব না কোথাও! কেঁদো না! যদি কোথাও যাই, মানে যেতে হয়, তোমাদের সঙ্গে নিয়েই যাব।.. নাও, এখন চোখ মোছো। বোকা মেয়ে কোথাকার।
চোখ মুছল সিসি। কিন্তু হাসি ফুটল না মুখে। কিশোরভাই, তুমিও কি আমাকে ডাইনী মনে করো? লোকগুলো যা বলেছে, বিশ্বাস করো?
পাগল নাকি! আমি কি ওগুলোর মত ছাগল? জন্তু জানোয়ারকে কথা শোনানোর ক্ষমতা আছে তোমার, গর্ব করার মত বিদ্যে এটা। এখন তো আমার রীতিমত দুঃখ হচ্ছে, আমিও শিখলাম না কেন?
শেখোনি ভাল করেছ। তাহলে তোমাকেও শয়তান বলত লোকগুলো।
তা তো বলতই।
তবে তোমার কিছু করতে পারত না। যা সাহস দেখলাম আজ তোমার। এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়ালে। মার্কের মত খেপা শুয়োরও তোমার ধমকে কুঁকড়ে গেল।…যা-ই বলো, ওর ভাইটার হাত ভাঙাতে আমি খুশিই হয়েছি। ঘাড় মটকে মরলে আরও খুশি হতাম।
খিলখিল করে হাসতে লাগল সিসি। বোনকে হাসতে দেখেই যেন হেনরিও হাসল।