খবরদার, ওর বেশি কাছে যেয়ো না! চিৎকার করে উঠল। একজন। মেয়েটা মানুষ না, পিশাচ!
শয়তানের পূজারী! বলল আরেকজন। জন্তু-জানোয়ারেও ওর কথা শোনে! দেখলে না কেমন করে নিজের ঘোড়াটার কানে কানে কথা বলল? খেপিয়ে তুলল ফ্রেঞ্চদের ঘোড়াগুলোকে! ওই ডাইনীটাই দুটো ঘোড়ার লড়াই লাগিয়েছে!
বেশির ভাগ লোক তার কথা সমর্থন করল। গুঞ্জন উঠল তাদের মাঝে। ভুরু কুঁচকে সিসির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে সন্দেহ।
ও ডাইনী। চিৎকার করে উঠল আরেকজন।
ঠিক ঠিক, ঠিক বলেছ! বলে উঠল অন্য আরেকজন। সুর করে বলতে শুরু করল, ডাইনী! ডাইনী! ডাইনী!
তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাল আরও অনেকে।
ওদের ভাবভঙ্গি দেখে শিউরে উঠল কিশোর। মনে পড়ে গেল মধ্যযুগের ডাইনী পোড়ানোর কথা।
০৬.
থামুন! থামুন আপনারা! দোহাই আপনাদের! শান্ত হোন! পাগলের মত চিৎকার শুরু করল কিশোর। সিসি ডাইনী নয়! তাকে আমি চিনি। তার মত ভাল মেয়ে কম দেখেছি আমি।
কিশোর ভাই, ওরা আমাকে যা-তা বলছে, কেঁদে ফেলল। সিসি। আমি খারাপ কিছু নই। মোটেও ঠিক নয় ওদের কথা।
সিসির দিকে তাকাল কিশোর। ওর সবুজ চোখের তারা পানিতে ঢাকা পড়েছে।
ঠিক তো নয়ই, আমি কি জানি না সেটা, সিসির কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর। ভয়ে কাঁপছে সিসি।
কিশোরের প্যান্ট খামচে ধরে পায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। হেনরি। ওর মাথায়ও আলতো চাপড় দিয়ে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর।
কি করে ভাবছে ওরা সিসির মত একটা মেয়ে ডাইনী হতে পারে? রাগ ফুঁসে উঠতে লাগল কিশোরের মনের মধ্যে।
ওকে খারাপ ভাবছেন কেন আপনারা? লোকগুলোকে বোঝাতে গেল সে। লং হার্ট জন্তু-জানোয়ারদের বশ করতে জানতেন, তাঁর সঙ্গে থেকে থেকে ওদের সামলাতে শিখেছে সিসি। জানোয়ারেরা তাকে বিশ্বাস করে। যেমন আমি করি।
দুই হাতে জনতাকে ঠেলে সরিয়ে এসে কিশোরের মুখোমুখি দাঁড়াল মার্ক ফ্রেঞ্চ। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। চিৎকার করে উঠল, ওই ইনডিয়ান হারামজাদাটাই ছিল যত নষ্টের গোড়া। ওর ভয়ে গাঁয়ের কেউ কথা বলতে পারত না। সবাই ভেবেছিল, মরেছে, গ-সুদ্ধ বেঁচেছে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে শয়তান কখনও মরে না। বংশধর রেখে যায়। সমস্ত তুকতাক শিখিয়ে দিয়ে গেছে এই ডাইনীটাকে। সিসির দিকে আঙুল তুলল সে। ডাইনীদের চেহারা ভালই হয়। নইলে মানুষের মন ভোলাবে কি করে?
সবাই মার্কের কথায় সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। জোরাল গুঞ্জন উঠল তাদের মাঝে।
আপনারা যা-ই বলুন, জনতার দিকে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, ঘোড়াগুলোর খেপে ওঠার পেছনে সিসির কোন হাত ছিল না। আপনারা নিজের চোখে দেখেছেন লাগাম টেনে ধরে সিসির ঘোড়াটাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল জন। পড়ে গেলে ঘোড়াটা সহ মারা পড়ত সিসি। পরের বার যখন আবার একই কাজ করতে গিয়েছিল, বেসামাল হয়ে পড়ে ওদের ঘোড়া দুটো। এটা কি সিসির দোষ?
কিশোরের দিক থেকে জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি জনতার দিকে ফেরাল মার্ক। অস্বস্তিতে পায়ের ওপর ভার বল করল কেউ কেউ। সবাই চোখ নামিয়ে নিল। মার্কের বিরুদ্ধে সত্যি কথাটা বলতেও ভয় পাচ্ছে ওরা। ওর আক্রোশের শিকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ধনে-প্রাণে মারা পড়তে চায় না। গলা শুকিয়ে গেল কিশোরের।
তুমি কি বলতে চাও আমার ভাই অন্যায় কিছু করেছে? কিশোরের দিকে এক পা এগিয়ে গেল মার্ক।
কি করেছে সেটা সবাই দেখেছে। আমি কেবল সত্যি কথাটা বললাম।
চোখের পাতা সরু সরু হয়ে এল মার্কের। ওই বাড়ির সবগুলো মানুষ শয়তান। ফকির-ফোকরা যেগুলো বাইরে থেকে আসে সেগুলোও শয়তান।
আমার তো ধারণা, ফকির-ফোকরাগুলো আসে বলেই এই শয়তানের গায়ে মানুষ এখনও বেঁচে আছে, নইলে বহু আগেই জমিদার-ফমিদারদের অত্যাচারে খতম হয়ে যেত। আর ফমিদারগুলোও তো বাইরে থেকেই ঘটি-কম্বল নিয়ে আসা। এখানকার নিরীহ মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে বড়লোক হয়েছে।
কি বললি! ফকিরের বাচ্চার এত্ত বড় সাহস! চড় মারার ও ভঙ্গিতে হাত উঠে গেল মার্কের।
দুই ধাক্কায় সিসি আর হেনরিকে দুই পাশে সরিয়ে দিল কিশোর। চোখের পলকে ডান পাটা চলে এল সামনে। সামনের দিকে সামান্য কুঁজো হয়ে গেছে দেহ। কারাতে মারের কায়দায় দুই হাত উঠে গেছে, একটা সামনে, একটা পেছনে। এর চীনা মারের এই ভঙ্গিটা মার্কের একেবারে অপরিচিত নয়। কিশোরের ক্ষিপ্রতা আর চোখের ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দমিয়ে দিল তাকে।
ভুরু নাচাল কিশোর, কি হলো, মারছ না কেন? মারো! দেখি তোমার তাকত! মেয়েমানুষের সঙ্গে হেরে ভূত হও, চালাকি করেও জিততে পারো না, আবার বড় বড় কথা বলতে এসেছ!
খবরদার! মুখ সামলে কথা বলবে! গর্জে উঠল মার্ক।
তাই তো করছিলাম এতক্ষণ! দুর্বল পেলে মারতে খুব মজা লাগে, না? তোমার ভাইয়ের ভেঙেছে হাত, আমি তোমার ঘাড়টা মটকে দেব। এসো! মারো!
কিশোরের মারমুখো ভঙ্গি দেখে আর এগোতে সাহস করল না মার্ক। এক পা পিছিয়ে গেল। দুই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আজকে ছেড়ে দিলাম। আরেকদিন এ রকম বেয়াদবি করতে দেখলে…
আমরা কিচ্ছু করিনি, জবাব দিল কিশোর। শয়তানিটা তোমরা শুরু করেছ। সিসিকে রেসে অংশ নিতে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না তোমাদের।
হ্যাঁ, সত্যিই নিতে চাইনি, মাথা ঝাঁকাল মার্ক। কেন জানো? কাচু-পিকচুতে তোমাদের চাই না আমরা। বাপ-মা দুটো উধাও হয়েছে। শয়তানের চেলা ছিল বোধহয়, শয়তানেই ধরে নিয়ে গেছে দোজখের মানুষকে জ্বালানোর জন্যে। বাকি দুটো চেলা ওয়্যাগন উল্টে মরেছে। বাকি আছ তোমরা। মাটিতে থুথু ফেলল মার্ক। সাহস করে কিশোরের চোখে আর ফেলতে পারল না। এতিমদের মিছিলের সঙ্গে বিদেয় হয়ে গেলেই পারো। শুনলাম, কয়েক দিনের মধ্যেই এখান দিয়ে যাবে একটা কাফেলা। যাওয়ার জন্যে সাহায্য চাইলে বরং সাহায্য করতে পারি। চাইকি, কিছু পয়সাও ভিক্ষে দিয়ে দেব।