ওরা যখন কাছে গেল, তুমুল ঝগড়া বেধে গেছে ততক্ষণে দুটো দলের মধ্যে। বুড়ো একজন লোকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পিটার, আমরা খেলবই। আপনি বাধা দেয়ার কে?
বুড়োর সব চুল সাদা। গায়ে লম্বা ঝুলওয়ালা উলের কোই।
নিচু স্বরে কিশোর আর মুসাকে জানাল রবিন, বুড়োর নাম জিথার জ্যাকসন। শীতকালে সব সময় ওই একটা কোটই পরে থাকে। টাকা-পয়সার যে অভাব তা নয়। অতিরিক্ত কিপটে। জ্যাকসনস বেইট শপ দোকানটার মালিক। এই লেকের পাড়ের একমাত্র দোকান। লোকে বলে ওর জন্মের পর থেকেই চালাচ্ছে।
দেখো না খেলে আবার। সমান তেজে চেঁচিয়ে পিটারের কথার জবাব দিল। বুড়ো।
খেলবই তো। কি করবেন?
বললাম না, খেলেই দেখো।
কঠোর আরেকটা জবাব দিতে যাচ্ছিল পিটার, চোখ পড়ল রবিনের দিকে। আরি রবিন; কখন এলে?
এই তো। একটু আগে, রবিন বলল। কি হয়েছে?
আরে দেখো না, হকি খেলতে বাধা দিচ্ছে। সব মাছ নাকি তাড়িয়ে দিচ্ছি আমবা। নিজেরা পারে না ধরতে, দোষটা এখন আমাদের।
হাই, রবিন। হাত নেড়ে ডাকতে দেখা গেল আরেকজন লোককে। মাথায় লাল ক্যাগ। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। এত উঁচু, সবার মাথার ওপর দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে।
হাই! হাত নাড়ল রবিন।
আজই এলে নাকি?
হুঁ।
হাতের ইশারা করল লোকটা, এসো এদিকে।
মেরিন ডগলাস, লোকটার দিকে এগোনোর সময় দুই বন্ধুকে জানাল রবিন। খুব ভাল মোটর মেকানিক।
রবিন কাছে যেতে দস্তানা পরা একটা হাত বাড়িয়ে দিল ডগলাস। কেমন আছ? কিশোর আর মুসার দিকে চোখ পড়তে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু। নাকি?
হ্যাঁ, হাতটা ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে জবাব দিল রবিন। ও কিশোর।…আর ও মুসা।…ডগলাস, এত গোলমাল কিসের?
শুনলেই তো পিটারের কাছে। কিশোরের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে জবাব দিল ডগলাস। তারপর হাত বাড়াল মুসার দিকে। ওরা তো বলে হকি খেলে। কিন্তু যে কাণ্ডটা করে তাকে হকি খেলা বলে না। বরফের ওপর দিয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকে। কোনদিন যে বিপদ ঘটাবে। হয় কারও শ্যান্টি ভাঙবে, নয়তো নিজেরাই বরফ ভেঙে পানিতে পড়ে মরবে।
শয়তানি করলে তো বিপদ হবেই। আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন? মাছ তাড়ায় বলে?
উঁহু। ভয়টা অন্যখানে। কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ কাউকেই নামতে দেবে না আর লেকে। মাছ ধরাটা তখন যাবে আমাদের।
সবচেয়ে বেশি রাগ তো দেখা যাচ্ছে জ্যাকসনের, কিশোর বলল। ফেটে পড়ছে। এ রকম করছে কেন?
করবে না? এখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে ওর ব্যবসা খতম। দোকানে লাল বাতি জ্বলবে যে। খেপাটা স্বাভাবিক।
পিটার কি করছে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল রবিন। জ্যাকসনের সঙ্গে ঝগড়া। তুঙ্গে উঠেছে পিটারের। হকি স্টিক তুলে বাড়ি মারতে গেল বুড়োকে। তাকে সাহায্য করতে এগোল তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডট আর কারনি। বয়েসে পিটারের দুতিন বছরের বড় হবে ওরা। গণ্ডগোল করার কারণে ওদেরকেও স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
জ্যাকসনও কম যায় না। কোমরের টুল বেল্টে ঝোলানো ছোট একটা কুড়াল একটানে খুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে বাড়ি মারবি? আয় তো দেখি কত্তবড় সাহস!
বাধা দিতে এগিয়ে গেল রবিন।
তার কথা কানেও তুলল না কেউ।
চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল কারনি। বেঁকিয়ে উঠল, নিজের চরকায় তেল দাওগে।
তবে খুনখারাবির মধ্যে কাউকেই যেতে দিল না জনতা।
পিটারদেরকে হকি স্টিক নামাতে বাধ্য করল। জ্যাকসনও আবার কুড়ালটা কোমরে ঝোলাল। কিন্তু কথার লড়াই বন্ধ করল না দুপক্ষের কেউই।
তীব্র স্বরে জ্যাকসন বলল পিটারকে, ভেবেছিস, চুরি-ডাকাতি করে এত সহজেই পার পেয়ে যাবি? আমি সব জানি!
কি জানো তুমি, বুড়ো ভাম কোথাকার! ঝাজিয়ে উঠল পিটার। মিথ্যে কথা বললে দেব এক বাড়িতে মাথাটাকে দুফাঁক করে।
আবার হকি স্টিক তুলল সে।
আবার কুড়ালে হাত দিতে গেল জ্যাকসন।
তবে দ্বিতীয়বারের মত আবার সামলে নিল নিজেদের।
পুলিশের সাইরেন কানে এল।
.
০২.
তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল লেকের কিনারে।
হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ অফিসার নেমে দৌড় দিল বরফের ওপর দিয়ে।
বরফে আটকানোর কাঁটা বসানো নেই ওদের বুটের নিচে। কাজেই প্রথম লোকটাই লেকে নেমে আছাড় খেল।
হেসে ফেলল মুসা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে লোকটা আবার উঠে দাঁড়াতেই রবিন বলল, ডোবার কগনান।
কাছে এসে জনতার দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল সে, একটা ফোন পেলাম, এখানে নাকি গণ্ডগোল হচ্ছে?
নিজের দলের কাছে ফিরে গেছে পিটার। চিৎকার করে বলল, জ্যাকসন নিজেকে এই লেকের মালিক দাবি করছে।
অ্যাই, পাজি ছোঁড়া, মিথ্যে কথা বলবি না! চেঁচিয়ে উঠল জ্যাকসনও। চোরের মার বড় গলা।
শুরু হলো জনতার গুঞ্জন। সবাই একসঙ্গে কথা শুরু করল। কিছু বোঝার উপায় নেই।
চিৎকার করে উঠল ডোবার, আহ, একজন একজন করে বলুন না!
স্কেইট করে তার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন।
অবাক হয়ে গেল ডোবার। আরি, তুমি এলে কখন? এরা কারা?
এই তো, খানিক আগে। কিশোর আর মুসার পরিচয় দিল রবিন।
কিশোরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল অফিসার। আমি ডোবার কগনান। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি রবিনের মুখে।
আপনার কথাও শুনেছি আমরা, হাত মেলাতে মেলাতে বলল কিশোর।
এদিকে এসো। কথা বলি। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ভিড়ের কাছ থেকে সরে গেল ডোবার। তার সঙ্গের অফিসাররা গিয়ে জনতাকে পাহারা দিতে লাগল, যাতে ঝগড়া করতে না পারে।