মেঘ সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। আলোকিত হয়ে উঠল আবার মুসার চারপাশের জায়গাটা। কিসের ওপর পড়েছে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। বরফের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে আছে কিশোর। নড়ছে না।
কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা।
সাড়া পেল না।
কিশোরের গায়ে জোরে জোরে ঠেলা দিতে লাগল। কিশোর! এই কিশোর?
পুরোপুরি সরে গেছে মেঘ। উজ্জ্বল তুষারে প্রতিফলিত ফকফকা জ্যোৎস্না। অনেক কষ্টে একটা চোখ মেলল কিশোর। ঠোঁট নীল। ফিসফিস করে বলল, জমে যাচ্ছি!
এত হট্টগোল শুনে লোকজনও ছুটে এল দল বেঁধে।
রকি আর জ্যাকিকে তুলতে গেল কয়েকজন।
চিৎকার করে বলল মুসা, এদিকে আসুন কেউ…কম্বল! স্লেড!
*
দশ মিনিট পর মিস্টার মরগানের বাড়িতে পৌঁছে গেল কিশোর, ডোবার কগনানের গাড়িতে চড়ে। স্নোমোবাইলটা পানিতে পড়ার পর ওখানে গিয়েছিল সে।
রকি আর জ্যাকিকেও তোলা হয়েছে। প্রচুর চাপ পড়ল বেলী আন্টির ওপর। বরফ-পানিতে ডোবা তিন তিনজন মানুষের ভেতরে-বাইরে গরম করতে গিয়ে। হিমশিম খেতে লাগলেন তিনি।
ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো।
.
১৫.
ফায়ারপ্লেসের গনগনে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে রবিন, মুসা আর ডোবার কগনান নিজেদের গরম করছে।
রকি আর জ্যাকিই আপনার আসামী; রবিন বলল। মাল চুরি করে নিয়ে গিয়ে বরফের নিচে লেকের তলায় লুকিয়ে রাখে ওরা। পরে সুযোগ সুবিধে মত বের করে। আমাদের ধারণা, ম্যারিল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ওগুলো। খোঁজ নিয়ে দেখুন। বের করে ফেলতে পারবেন।
ওখানে আর খোঁজ নিতে যাওয়ার দরকার নেই, কঠোর পুলিশী কণ্ঠে বলল ডোবার। ওদের মুখ থেকেই বের করে নেব।
দরজার কাছে হই-চই শোনা গেল। দেখা গেল পিটারের কাঁধে ভর দিয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ঢুকছে রয়।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ তোমরা দুজনে? জানতে চাইল ডোবার।
শয়তান জ্যাকিটা ইস্পাতের রড দিয়ে আমার পায়ে বাড়ি মারল, রয় বলল। পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়াতে থাকলাম…
আমি ওকে দৌড়াতে দেখলাম, পিটার বলল। যে ভাবে ছুটছিল, থেকে থেকেই ভাজ হয়ে যাচ্ছিল পা, বুঝলাম পায়ের অবস্থা কাহিল। বেশি দূর যেতে পারবে না। পিছে পিছে ছুটলাম।
গিয়েছিলে বলেই বেঁচেছি, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রয়। কিভাবে যে লেক থেকে উঠে গিয়ে বনের মধ্যে ঢুকলাম বলতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। হুঁশ হলে দেখি হাতে বানানো স্ট্রেচারে করে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পিটার। ওকে যে আমি কি বলে…
তাকে থামিয়ে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল পিটার, ছোট্ট এই গল্পটার এখানেই সমাপ্তি।
না, সমাপ্তি নয়, রয় বলল। পিটার, আমাকে বলতে দাও। তুমি আমার পিছু না নিলে বনের মধ্যে আজ মারাই যেতাম। বরফের মধ্যে বেহুশ হয়ে যে ভাবে পড়ে গিয়েছিলাম, হুঁশই হয়তো আর ফিরত না…
থাক থাক, হাত তুলে বাধা দিল পিটার। খবরটা আর ছড়ানোর দরকার নেই। বিরাট হৃদয়ের অধিকারী, মহান উদ্ধারকারী-এ সব বিশেষণে ভুবন বিখ্যাত হয়ে যাব শেষে।
রয়কে বেডরূমে নিয়ে গেল ডোবার। বেলী আন্টি আর ডাক্তার মিলে ওখানে অসুস্থদের সেবা করছেন।
পিটারও ওদের সঙ্গে ঢুকল। ফায়ারপ্লেসের সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
তারমানে ভাল কাজ একটা করেই ফেললে, পিটারের ওপর থেকে রাগ যায়নি রবিনের। কিন্তু তাই বলে, তোমার জায়গা ছেড়ে সরে আসার কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আমি। তুমি তখন সরে না এলে ঘটনাটা অন্য রকম ঘটত।
কৈফিয়তের ভঙ্গিতে পিটার বলল, দেখো, রবিন, তুমি তিন গোয়েন্দার একজন। সোনার টুকরো ছেলে। সব সময়ের হিরো। তোমার মত গোয়েন্দা আমি হতে পারব না। সবই মেনে নিলাম। কিন্তু দুই ভাইকে বাধা দিয়ে আমি ঠেকাতে পারতাম না। মারামারি করে পারতাম না ওদের সঙ্গে। পিটিয়ে তক্তা বানাত। তারপর-ঠিকই স্নোমোবাইলটা নিয়ে চলে যেত।
তক্তা বানালে বানাত, নরম হলো না রবিন। মরে তো আর যেতে না। কিন্তু তোমার ভীতুপনার জন্যে কি সর্বনাশটাই না ঘটতে যাচ্ছিল।
যা ঘটেছে সেটা আমি সরে না এলেও ঘটত, পিটার বলল। আমার কথা শেষ করতে দাও। আড়াল থেকে দুই ভাইয়ের কথা শুনেই আমি বুঝেছিলাম স্নোমোবাইল নিয়ে বেরোবে ওরা। চুপচাপ গিয়ে ট্যাংকের সব তেল ফেলে দিলাম। তারপর গেছি তোমার কাছে।
নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। কি করেছ। তুমি কি করেছ?
রবিনের কথায় কান দিল না পিটার। কেন সরতে না পেরে সোজা গিয়ে বরফ ভেঙে পানিতে পড়ল স্নোমোবাইল? ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে। কেন বন্ধ হলো ইঞ্জিন? ট্যাংকের ইিপ লাইন আর কারবুরেটরের সামান্য তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে।
পিটারকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল রবিনের। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে ওর একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
বাহ্, হাসিমুখে বলল পিটার, হিরো তাহলে শেষমেষ হয়ে গেলাম আমিও। চোরের অপবাদ থেকে হিরো!
*
একটু সুস্থ হতেই জ্যাকি আর রকিকে নিয়ে রওনা হলো পুলিশ। প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পুরোপুরি সুস্থ হলে হাজতে নেবে।
গাড়িতে উঠতে যাবে দুই ভাই, এমন সময় গাড়ি নিয়ে ঢুকল জিথার জ্যাকসন।
ঘটনাটা কি? চিৎকার করে উঠল সে।
আপনি না এলে প্রশ্নটা আমরা আপনার বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, জবাব দিল ডোবার। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
দুই ভাইকে ধরে জ্যাকসনের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করল সে।